
অনেক অনেকদিন আগে এক পাহাড়ে দুই বোন বাস করতো।
তাদের কোন ভাই না থাকায়, বাবা ও মার কাছে তারাই ছিল একমাত্র আশ্রয়।
তারা কিছু এনে না। দিলে তাদের খাওয়া দাওয়া হতো না। দুই বোন রোজ জুমে যায়, গাছ ও ফসলের পরিচর্যা করে।
কিন্তু বড় বোনের রংঢংটা যেনো অন্য রকম। গাছে চিনার ধরা মাত্র ছোট বড় বাছ বিচার না করে সবই খেয়ে ফেলে।
ফলে সে আর চিনার ঘরে আনতে পারে না। কিন্তু ছোট বোনটি আলাদা। সে তা না করে, একটি একটি করে চিনার বাবা, মা ও পাড়া-পড়শীদের নামে টং-এ এনে জমিয়ে রাখে।
এক সময় চিনারে চিনারে তার সারা ঘর ভর্তি হয়ে যায়। একদিন ছোট বোন সাইজোস-এ নেই।
বড় বোন তার খোজ করতে এসে টং এর মধ্যে হাজার হাজার চিনারের সন্ধান পায়। তার লোভ হয় এবং সমস্ত চিনার খেয়ে ফেলার ষড়যন্ত্র করে।
সে ছোট বোনকে ডেকে এনে বলে তোর ঘরে একফোঁটাও জল নেই। যা অনহর থেকে খাওয়ার জল নিয়ে আয়।
হোট বোন দিদিকে জল খাওয়ানোর জন্য হাতে একটা তিউম নিয়ে টীলার ঢালুতে নেমে যায়। আর এই সুযোগে বড় বোন ঘরের সমস্ত চিনার খেয়ে ফেলে।
ছড়া থেকে জল এনে ছোট বোন দেখে তার ঘরের মধ্যে একটাও চিনার নেই। সে কাঁদতে শুরু করে।
কেঁদে কেঁদে বলে, আমি সবার জন্য একটা একটা করে চিনার জমিয়ে রেখে ছিলাম, আর তুমি সব খেয়ে ফেললে।
এখন আমি কি করি? কি নিয়ে বাড়ী যাই? কাদতে কাঁদতে সে বার বার অজ্ঞান হয়ে পড়ে ও কপালে করাঘাত করতে থাকে।
বড় বোন তার মাথায় , চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে সান্তনা দেয়। বলে চল। আমরা দাদুর রেখে যাওয়া দোলনাটায় দোল খেয়ে আসি।
দোলনাটি ছিল একটা বিশাল গাছের লতা ছড়ার দুদিকে দুটো বড় গাছের সঙ্গে জড়ানো। বড় বোন ছোট বোনকে সেই দোলনায় তুলে জোরে জোরে দোল দিতে থাকে।
এত জোরে দোল দেয় যে, দোলনাটা ছিড়ে গিয়ে ছোট বোন ছড়ার জলে গিয়ে পড়ে। পড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা ঙাসেন তাকে খপ কের গিলে ফেলে।
বড় বোন এবার খালি হাতে বাড়ী ফিরে আসে। বাবা মা তাকে জিজ্ঞেস করে ছোট বোন কোথায়?
বড় বোন আশ্চার্য হওয়ার ভান করে বলে, সারাদিন ধরে তো সে আমার কাছে ছিলোনা।
বাবা মা বলে , কেননা? সকালে তো তোমার সাথেই বেরিয়ে গিয়েছিল- আর এখন বলছ যে তোমার সঙ্গে ছিলোনা? বড় বোন নীরব থাকে।
বাবা মা ছোট মেয়ের নিখোঁজের কথা সবাইকে জানায়। বন-পাহাড় তন্ন তন্ন করে খোজা হয়। কিন্তু কোথায়ও তার খবর পাওয়া যায় না।
আটদিন পর ছড়ার ঘাটে, খারপানি দিয়ে বাবা মায়ের চান করার সময়, মাছের পেটের মধ্যে থেকে ছোট মেয়ে সেই খারের গন্ধ এবং বাবা মায়ের কথাবার্তা শুনতে পায়।
শুনে সেও মাছের পেটের মধ্য থেকে বিলাপ করে। “কাপা নায়ক যামরো।
কানু, নায়ক যামরা” অর্থাৎ বাবা আমাকে আস্তে আস্তে তোল। মা আমাকে আস্তে আস্তে তোল।
বাবা এই কথাগুলি শুনে বুঝতে পারে, তার ছোট মেয়েটি জলের বিশাল মাছটার পেটের মধ্যেই আছে।
স্ত্রীকেসেকথা জানিয়ে বলেন, বাড়ী থেকে দ্রুত লেন(জাল) নিয়ে আসার জন্য। মা আথারি-পাথারি দৌড়ে জাল না এনে উৎকণ্ঠায় একটা বাঁশের চাটাই নিয়ে আসে।
তাঁর এই কাজে বাবা খুব রাগান্বিত হয়। এবং ঝগড়া শুরু হয়।
যাহোক শেষে মা দৌড়ে গিয়ে জাল নিয়ে এলে তারা মাছটাকে ধরে, একটা বাঁশের খাড়ার মধ্যে করে বাড়ীতে নিয়ে আসে, এবার মাছের পেট থেকে মেয়েটি বলে মাছটাকে আস্তে আস্তে কাটার জন্য যাতে, তার শরীরে কোন আঘাত না লাগে।
তারা মাছটাকে আস্তে আস্তে কাটে ও মেয়েটি বের করে আনে।
এই ঘটনার পর বাবা-মা বড় মেয়ের উপর আরো খেপে যায় এবং বিরাট বড় একটা মোরগ রাখার খাঁচা তৈরী করে।
এ খাঁচা দেখে বড় মেয়ে বলে, এত বড় মুরগীর খাঁচা দিয়ে তোমরা কি করবে?জবাবে বাবা বলে আমাদের একটা বড় মোরগ আছে, ওটাকে এই খাঁচায় ঝুলিয়ে রাখব।
পরের দিন সকাল হতে না হতেই তারা বড় মেয়েকে ঐ খাঁচায় পুরে একটা বড় গাছের মগডালে খাঁচাশুদ্ধ ঝুলিয়ে রেখে জুমে চলে যায়।
বিকেলে ফিরে এসে, সেই মাছটিকে কেটে খন্ড খন্ড করে, ভেজে সবাই মিলে খায়। বড় বোন শুধু উপর থেকে দেখে।
আর কিছুই করার থাকে না তার। খাওয়া দাওয়ার পর বাবা-মা নিচের বাজার থেকে গিয়ে নকুল, বাতাসা ও জীলিপি কিনে নিয়ে আসে।
ছোট বোন হাত ভর্তি করে সেগুলো ঐ বড় গাছের নিচে গিয়ে, দিদিকে দেখিয়ে বলে, দেখ দিদি, আমি নকুল-বাতাসা খাচ্ছি।
দিদি স্বভাব সুলভভাবে কাতর আবেদন করে-আমাকে একটু দে না। ছোট বোন মাকে ডেকে বলে, মা মা দিদি আমার কাছে নকুল-বাতাসা চায়।
মা রেগে বলে—ওর মুখে থুথু দে। ছোট বোন তাই করে। বড় বোন পেটের খিদেয় তাই খেয়ে ফেলে।
পরের দিন সকালে, ছোট হাতে মুঠো ভর্তি ভাত নিয়ে গিয়ে দেখায়- দেখো দিদি আমি ভাত খাচ্ছি। বড় বোন বিদেয় পাগল হয়ে বলে, আমাকে একটু দে- আমাকে একটু দে।
ছোট মাকে বলে, মা মা বড় বোন ভাত খেতে চায়। মা বলে-ওকে তোর পায়খানা দে। ছোট বোনও তাই করে।
একদিন বাবা ও মা জুমের শেষ ফসল তোলার জন্য জুমে গেছে। বড় বোন তা দেখে, ছোট বোনকে ডাকে। ছোট! ছোট! একটু শোন না।
ছোট বোন সামনে এলে সে বলে, আমাকে একটু নামা না ভাই? কতদিন হলো ভাত খাইনি। তুই আজ বড় করে এক হাঁড়ি ভাত বসা।
ছোট বোন তাকে গাছ থেকে নামিয়ে দেয় এবং ভাত বসায়।
ভাত হলে তারা দুজনেই খায়। এক সময় বড় বোন কথার ছলে বলে- ছোট! অনেক দিন হলো সেলাই ফুড়াই করিনি।
পাশের বাড়ী থেকে একটু সূচ সুতো নিয়ে আয় না? ছোট বোনটি সুচ সুতোর জন্য বেরিয়ে গেলো। বড় বোন বাইরে এসে দাঁড়ায় দেখে-আকাশে অসংখ্য রালাই পাখী উড়ে যাচ্ছে।
সে হাঁটু গেড়ে বসে তাদের দিকে তাকিয়ে প্রার্থনার সুরে বলো
“রালাইঙাইয় রালাইঙাইয়
মান যা বংখাত বংখাত মাস্থলর”,
অর্থাৎ, ওরালাই ও রালাই। অর্থাৎ তোমাদের কাছে থেকে
একটা একটা পালক, আমি একটু চাই।
তার কথা শুনে, পাখীরা উপর থেকে ঝর ঝর করে প্রচুর পালক ফেলে দেয়। বড় বোন পাখীদের বলে- তোমরা একটু অপেক্ষা কর।
আমি এক্ষুনি ঘর থেকে আসছি। এদিকে ছোট বোন সুচ সুতো নিয়ে এলো।
বড় বোন আড়ালে আড়ালে ঐ পালকগুলো পর পর সেলাই করে একটা বিশাল পাখা বানিয়ে, নিজের শরীরে লাগিয়ে উড়ে-উড়ে বাড়ীর একটা গর্জন গাছের উপরে গিয়ে বসে।
ছোট বোন তা দেখতে পেয়ে, দৌড়ে এসে বলে- কোথায় যাচ্ছিস? আমাকেও নিয়ে যা না? বড় বোন বললো— আমি একেবারে চলে যাচ্ছি।’
রাত্রি হলে তুই আমার সমস্ত গয়না-পত্তর বারান্দায় রেখে দিবি। আমি বাতাসের মতো এসে সব নিয়ে যাবো।
এদিকে আকাশে অপেক্ষমান পাখীরা তাকে তাড়া দেয়, চলে এলো-চলে এলো। আর দেরী কেনো। বড় বোন বিশাল ডানা মেলে এবার আকাশে ওড়ে।
নিচে ছোট বোন কাঁদতে থাকে। বড় বোন তা দেখে ও আরো নিচে নেমে আসা পাখীদের ঝাঁকে মিশে গিয়ে সারা জীবনের জন্য পাহাড়ের আরো উপরে শুণ্যে মিলিয়ে যায়।
তথ্যসূত্র: ত্রিপুরার আদিবাসী লোককথা