
লুসাই পরিবারে স্বামী ও স্ত্রীর বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করাকে ‘ইনমাক’ বলা হয়।
স্বামী কিংবা স্ত্রী যে কোনো একজনের মৃত্যুতে লুসাই সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত একটি দাম্পত্য জীবন তথা বিবাহিত জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। তবে সমাজ ও আইন স্বীকৃত উপায়ে নিম্নবর্ণিত কারণে স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে জীবদ্দশায় বৈবাহিক সম্পর্কের পরিসমাপ্তি বা ‘ইনমাক’ হতে পারে।
ক) স্বামী-স্ত্রী উভয়ে স্বেচ্ছায় সামাজিক আদালতের দ্বারস্থ হয়ে সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তাদের বিচ্ছেদ হলে সেটাকে ‘ইনমাক’ বলে।
খ) সামাজিক আদালত বা বিচার বিভাগীয় কার্যক্রম দ্বারা ‘ইনমাক’ করা যাবে।
গ) ইদানীং শিক্ষিত সমাজে স্বামী বা স্ত্রী কর্তৃক বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট /নোটারী পাবলিক-এর নিকট হলফনামা সম্পাদন মূলে ‘ইনমাক’ প্রেরণ করতে দেখা যায়। সেক্ষেত্রে সম্পাদিত হলফনামার কপি একপক্ষ তার নিযুক্ত আইনজীবির মাধ্যমে অপরপক্ষকে প্রেরণ করে থাকে (যদিও তা প্রথাসিদ্ধ নয়)।
ঘ) স্বামী অন্যত্র বিয়ে করলে তাকে পূর্ব সংসারের সব কিছু ত্যাগ করে খালি হাতে চলে যেতে হয়। এ ধরনের বিচ্ছেদকে সাজুমেইদ বলে।
কোন কোন ক্ষেত্রে স্বামী বা স্ত্রী ‘ইনমাক’ দাবী করার অধিকার লাভ করে।
নিম্নোক্ত কারণে লুসাই সমাজে স্বামী বা স্ত্রী ‘ইনমাক’ প্রদানের অধিকার লাভ করেঃ
ক) স্বামী যদি দৈহিক মিলনে অক্ষম বা পুরুষত্বহীন হয় কিংবা স্ত্রী গর্ভধারণে অক্ষম হয়, সেক্ষেত্রে স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একজন যথোপযুক্ত ডাক্তারী পরীক্ষার সনদপত্র দ্বারা ‘ইনমাক’ দাবী করতে পারে।
খ) স্বামী বা স্ত্রী যদি পরকীয়া কিংবা ব্যভিচারে বা নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে লিপ্ত হয় তাহলে এ ধরণের অপরাধের জন্য যে কোনো একজন তাদের সামাজিক আদালতে দোষী সাব্যস্ত হলে অপরজন ‘ইনমাক’ দাবী করতে পারে।
গ) স্ত্রীর সম্মতি বা অনুমতি ব্যতিরেকে স্বামী দ্বিতীয়বার বিবাহ করলে, সেক্ষেত্রে সতীনের সাথে একত্রে বসবাসে অসম্মত হয়ে প্রথমা স্ত্রী ‘ইনমাক’ দাবী করতে পারে।
ঘ) স্বামী বা স্ত্রী উভয়ের যে কেউ নিরুদ্দেশ হলে এবং বহু বছর যাবৎ উভয়ের মধ্যে কোনো প্রকার দাম্পত্য সম্পর্ক বা পারিবারিক যোগাযোগ না থাকলে সেক্ষেত্রে যে কোনো এক পক্ষ সামাজিক আদালতে একতরফাভাবে ‘ইনমাক’ সম্পাদন করে দ্বিতীয় বিবাহে আবদ্ধ হতে পারে।
ঙ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একজন যদি কিংবা মানসিক বিকারগ্রস্ত অথবা বিকৃত রুচির হয়, সেক্ষেত্রে অপরপক্ষ সামাজিক আদালতের মাধ্যমে ‘ইনমাক’ প্রদান করতে পারে।
চ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো একজন কৃত জঘন্য অপরাধে দন্ডিত হয়ে যদি দীর্ঘদিন কারাভোগে থাকে, সেক্ষেত্রে অপর পক্ষ সামাজিক আদালতের মাধ্যমে একতরফাভাবে ‘ইনমাক’ দাবী করতে পারে।
ছ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো এক পক্ষ নিষ্ঠুর প্রকৃতির, অহেতুক সন্দেহপ্রবণ, মাদকাসক্ত, নির্যাতনকারী হলে সেক্ষেত্রে অপরপক্ষ সামাজিক আদালতের মাধ্যমে ‘ইনমাক’ সম্পাদন করতে পারে।
জ) স্ত্রী যদি স্বামীর সংসারে প্রাপ্য ভরনপোষণ, ন্যায্য অধিকার, চিকিৎসা-সেবা ও পারিবারিক মর্যাদাসহ স্ত্রীর অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় সেক্ষেত্রে স্ত্রী সামাজিক আদালতের মাধ্যমে ‘ইনমাক’ সম্পাদন করতে পারে।
ঝ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো এক পক্ষ যদি অবিশ্বস্ত বা অবাধ্য হয়, পারিবারিক দায়িত্ব ও কর্তব্য প্রতিপালনে অনিচ্ছুক বা উদাসীন হয়, সেক্ষেত্রে অপরপক্ষ সামাজিক আদালতের মাধ্যমে ‘ইনমাক’ প্রদান করতে পারে।
ক) সমাজ স্বীকৃত পদ্ধতিতে সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ‘ইনমাক’ সম্পাদিত হলে স্বামী-স্ত্রী যে কেউ পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে।
খ) ‘ইনমাক’ সম্পাদনের পর স্বামী বা স্ত্রী এমনকি উভয়ের সম্মতিতে দৈহিক মিলন অবৈধ হয়। এরূপ দৈহিক মিলনের কারণে গর্ভজাত সন্তান অবৈধ বা জারজ সন্তান হিসেবে গণ্য হয়।
গ) স্বামী বা স্ত্রী যে কোনো পক্ষ দ্বারা ‘ইনমাক’ সম্পাদনের পর পারস্পরিক সমঝোতা ও আস্থা প্রতিষ্ঠিত হলে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপনের জন্য ‘ইননেইহয়না’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পুনঃ বিবাহ দ্বারা সামাজিক স্বীকৃতি অর্জন করতে হয়।
ঘ) ‘ইনমাক সম্পাদনের পর স্বামী ও স্ত্রী পারস্পরিক অধিকার ও কর্তৃত্ব হারায়। ‘ইনমাক’ সম্পাদনের বেলায় স্বামী দোষী সাব্যস্ত হলে স্ত্রী ও সন্তানের অনুকুলে তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ত্যাগ করতে।
চ) স্বামী-স্ত্রী যে কারোর কারণে ‘ইনমাক’ সম্পাদন হোক না কেন সেক্ষেত্রে সন্তান পিতার উত্তরাধিকারী হয়। ইনমাক সম্পাদনের বেলায় স্ত্রী দোষী সাব্যস্ত হলে স্বামীর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তিসহ প্রাপ্য ভরনপোষণ হতে স্ত্রী বঞ্চিত হয় এবং স্বামী সরকারী চাকুরীজীবি হলে তার মৃত্যুর পর ‘ইনমাক’ প্রাপ্ত স্ত্রী তার পেনশন সুবিধা হতে বঞ্চিত হয়।
ছ) স্বামী যদি স্বেচ্ছায় বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটায় সেক্ষেত্রে স্ত্রীর বরাবরে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির অংশসহ ‘মান ইন ব্লান’ এর সমপরিমাণ টাকা জরিমানা দিতে হয়। আবার স্ত্রী যদি স্বেচ্ছায় বিচ্ছেদ ঘটায় সেক্ষেত্রে স্বামীর কাছ থেকে কিছুই পায় না।
ক) ‘ইনমাক’ বা বিবাহ বিচ্ছেদের সময় স্ত্রী যদি গর্ভবতী অবস্থায় থাকলে অনাগত সন্তানের দায়-দায়িত্ব থাকে অথবা ‘ইনমাক’ সম্পাদনের পর স্ত্রীর দ্বিতীয় বিবাহ সত্ত্বেও যদি ধাত্রী বিদ্যামতে প্রমাণিত হয় যে, বিচ্ছেদ পূর্ব সময়ে স্ত্রী গর্ভবতী ছিল, সেক্ষেত্রে ভিন্ন কিছু নিশ্চিত প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত পূর্ব স্বামীকে উক্ত সন্তানের পিতৃত্বের স্বীকৃতি দিতে হয়।
সন্তান অবৈধ বা জারজ গণ্য হয় না। উক্ত সন্তান তার পিতার নিকট হতে ভরনপোষণ পায় এবং আইনগত উত্তরাধিকারী হয়।
বিচ্ছেদকালে যদি স্ত্রী গর্ভবতী থাকে তাহলে সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্ত মতে স্বামীর নিকট হতে ভরনপোষণসহ সন্তান প্রসবের যাবতীয় খরচ পায়।
তবে উক্ত সন্তানের বয়স তিন বছর না হওয়া পর্যন্ত মায়ের হেফাজতে রাখার অধিকার থাকে।
বিচ্ছেদ প্রাপ্ত স্ত্রীর অন্যত্র বিবাহ হলে, সেক্ষেত্রে সন্তান যদি মাতৃদুগ্ধ পান করে তাহলে সন্তানের পিতা সামাজিক আদালতের সিদ্ধান্ত অনুসারে নাবালক অবস্থায় সন্তানের অভিভাবক হয়।
খ) বিবাহ বিচ্ছেদ বা ‘ইনমাক’ সম্পাদনের তারিখ পরবর্তী ২৮০ দিন পর বিচ্ছেদপ্রাপ্ত স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তানের দায়-দায়িত্ব লুসাই সমাজের রীতিনীতি অনুসারে স্ত্রীর পিতামাতার উপর ন্যস্ত হয় অথবা সামাজিক আদালত নির্ধারণ করে।
আরো পড়ুন – লুসাই জনগোষ্ঠীর উত্তরাধিকার
তথ্যসূত্রঃ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের আদিবাসীদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইন (গ্রন্থনা ও সম্পাদনা – এডভোকেট জ্ঞানেন্দু বিকাশ চাকমা, এডভোকেট প্রতিম রায়, সুগত চাকমা)।