
অনেকদিন আগে এক পাহাড়ের গায়ে বাস করতো এক জুম চাষী আর তার বৌ। ওদের কোনও ছেলেমেয়ে ছিলনা।
চাষীর ছিল এক বোন। একদিন জুমে কাজ করার সময় সাপের ছোবলে বোনের স্বামী মারা গেল।
তার কিছুদিন পর বোনটিও মারা গেল। রেখে গেল ওদের একমাত্র মেয়ে কুফুরতিকে।
কুফুরতির মা-বাবা কেউ নেই। তাই মামা আর মামীই কুফুরকে লালন পালন করতে লাগলো।
কুফুর ছিল অসামান্য সুন্দরী। গুণেও ছিল অসামান্যা।
কাজেকর্মে তার জুড়ি পাওয়া ভার। মামা-মামীকে সে নানাভাবে সাহায্য করে থাকে। ওরাও ওকে খুব ভালবাসে।
কুফুর বড় হতে থাকে। ওদিকে আকাশে রোজ চাঁদ ওঠে। কুফুর আনমনা হয়ে সুন্দর চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকে।
ভাবে, কি সুন্দর চাদ। চাদের ভিতর থেকে এক সুন্দর পুরুষ কুফুরতিকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। পুরুষটির সাথে কুফুরের নীরবে কথা হয়।
ক্রমে ক্রমে পুরুষটিকে কুফুর ভালোবেসে ফেলে। এই লােকটি হল স্বয়ং চন্দ্রমাদেব।
বসন্তকালের এক নিস্তদ্ধ রাতে সবাই যখন অঘোরে ঘুমোচ্ছ, কুফুর স্বপ্ন দেখলো চন্দ্রমাদেব যেন স্বয়ং এসেতাকে বললেন,“কুফুর আমি এসেছি।
তুমি আমাকে গ্রহণ করো”। চন্দ্রমাদেব কুকুরের পাশে সারারাত জেগে রইলেন।
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে কুফুর বারবার স্বপ্নের কথা ভাবতে লাগলো। একবার ভাবলো এ নিছক স্বপ্ন। আবার মনে হচ্ছে এ স্বপ নয়, বাস্তব।
পরদিন চন্দ্রমাদেবের প্রত্যাশায় রাতে কুফুর আর ঘুমোলোনা।
সত্যি সত্যিই নিশুতি রাতে.চন্দ্রমাদেব কুফুরের সঙ্গে মিলিত হতে লাগলেন। কিন্তু একথা কেউ জানতে পারলোনা।
যতই দিন যেতে লাগলো কুফুরের শরীরেও নানারকম পরিবর্তন হতে লাগলো।
কুফুর সন্তানসম্ভবা হয়েছে মামা-মামী তা বুঝতে পারলো। একদিন মামী ওকে জিজ্ঞেস করলো —“বল দেখি তুই কাকে ভালোবাসি।
তোকে দেখে মনে হচ্ছে তুই মা হতে যাচ্ছি। তুই যার নাম বলবি, আমরা তার সাথেই তোর বিয়ে দেবো।”
কুফুর মামীর কাছে চন্দ্রমাদেবের গোপন অভিসারের কথা খুলে বললো। আরও বললো যে চন্দ্রমাদেবকেই সে বিয়ে করবে।
একথা শুনে মামা-মামী তো অবাক। চন্দ্রমাদেব হলেন দেবতা। তার সাথে মানুষের বিয়ে কি করে হবে!
এ কান সে কান করে কুফুরের কথা সকলেরই জানা হয়ে গেল। মামা-মামী লজ্জায় আর মুখ দেখাতে পারেননা।
গায়ের সর্দার ও বড়রা একদিন সবাই মিলে কুফুরের মামাকে কথাটা জিজ্ঞেস করলো। কুফুর যে কথা বলেছিল, মামা সে কথা সবাইকে বললো।
কিন্তু সবাই কথাটাকে আজগুবি বলেই ধরে নিলো। মানুষের সঙ্গে দেবতার মিলন কি করে সম্ভব হবে? এ কখনো হতে পারেনা।
তাহলে কুফুরের এই দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী কে? নিশ্চয়ই মামা নিজে। কারণ কুফুরের বাড়ীতে মিশে আর তো কোনও পুরুষ মানুষ নেই।
লজ্জায় মামা যেন মাটিতে মিশে গেল। কুফুরও মামার অপবাদে নীরবে চোখের জল ফেললো।
সবকিছু বিচার করে গায়ের লোকেরা কুফুরের মামাকে বললো যে কুফুরকে গাঁ থেকে বের করে দিতে হবে।
আর যদি তা না করে তবে কুফুরের মামা-মামীকে একঘরে করে দেওয়া হবে। গায়ের লোকের কথা মান্য করতেই হবে।
তাই একদিন কুফুরের মামা গাঁ থেকে সামান্য দূরে একটা পুরোনো জুমের গীয়রিঙ-এ কুফুরকে রেখে এলো।
সেখানেই কুফুর একা একা থাকে। বারান্দায় বসে কুফুর খুব কাদলো। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতেই চন্দ্রমাদেব নেমে এলেন কুফুরের কাছে।
কুফুর কেঁদে কেঁদে চন্দ্রমাদেবকে সব কথা বললো। চন্দ্রমাদেব ওকে অনেক সান্ত্বনা দিলেন। তিনি বললেন,“ভয় করোনা কুফুর।
আমি তোমাকে সবসময় দূর থেকে দেখবো। কেউ তোমার কোনও ক্ষতি করতে পারবেনা।
তুমি এবং তোমার ছেলের মধ্য দিয়ে কোনও এক দেবতার পূজার প্রচার হবে বলে তোমাকে এই কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে।
শীঘূগিরই তোমার কোলে আমার ছেলে আসবে। ওর দ্বারাই তোমার সব দুঃখ দূর হবে। তুমি আমাকে যখনই ডাকবেআমি তখনইছুটে আসবো।” এই বলে চন্দ্রমাদেব চলে গেলেন।
যে গীয়রিঙে কুফুর থাকে, তার পাশে একটু জমি ছিলো সেখানে কুফুর জুম।
চাষ করতে লাগলো। সারাদিন জুমের কাজে সে ব্যস্ত থাকে আর সন্ধ্যা হলেই গীয়রিঙে। নেমে আসেন চন্দ্রমাদেব।
সারারাত দুজনে গল্প করে কাটায়। এভাবেই কুফুরের দিন যাচ্ছে।
কিছুদিন পর কুফুরের একটি সন্তান হলো। কিন্তু সে মানুষ নয়। একটি সোনাব্যাঙ। নাতি দেখে মামা-মামীর চোখ ছানাবড়া। মানুষের ঘরে কি সোনাব্যাঙ জন্মায়?
কুফুর কিন্তু ওকে খুব ভলোবাসে।
দোলনা দুলিয়ে ঘুম পাড়ায় আর ঘুমপাড়ানি গান গেয়ে শোনায় স্বপ্ন ছিল চাঁদের ছেলে চাদের মতো হবে তার সারা গায়ে জ্যোত্সা মাখা রবে।
সোনাব্যাঙের রূপ নিয়ে যে এলো সোনামণি নিদ্রাদেবীর যত ঘুম সোনায় দেবে জানি।
চাদের ছেলে বলে কুফুর ছেলের নাম রাখলো চন্দ্রকুমার। দিনে দিনে সে বড় হতে লাগলো। তার ভীষণ বুদ্ধি।
একদিন ও মাকে জিজ্ঞেস করলো –“আচ্ছা মা, গাঁয়ের সবারই বাবা-মা দুজনে মিলে জুমে কাজ করে কিন্তু বাবা তোমার সঙ্গে কাজ করেন না কেন?”
কুফুর বললো — তোমার বাবা দেবতা। তিনি আকাশে থাকেন।
কুফুর আবার বললো –“কিন্তু আমরা যে ভাঙা ঘরে থাকি, তিনি তো আমাদের একটা ভাললাগৗয়রিঙ-ও তৈরী করে দিতে পারেন।”
মা বললো -“তুমি চাইলে তৈরী করে দেবেন নিশ্চয়ই।”
ছেলে বললো- “আমি কি করে বাবার দেখা পাব?” মা বললো-“একমনে যদি বাবাকে ডাকো তবে নিশ্চয়ই তিনি এসে দেখা দেবেন।”
পরদিন চন্দ্রকুমার মায়ের কাছে বায়না ধরলো সে এদিক ওদিক বেড়াতে যাবে। কুফুর ভয় পায়।
ছেলে মাকে অভয় দিয়ে বলে তুমি কিছুটি ভেবোনা মা, আমি ঠিক ফিরে আসতে পারবো।
ছেলের আব্দারে বাধ্য হয়ে কুফুর গৗয়রিঙ থেকে চন্দ্রকুমারকে নিচে নামিয়ে দিলো। সে আপনমনে গান গাইতে গাইতে থপ থপ করে লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে চললো।
আমি মায়ের সোনামণি।
আমায় মারবে কে! আমি হলাম চাদের ছেলে।
আমায় খাবে কে! কিছুদূর গিয়েই ঝোপের আড়ালে সুবিধা মতো জায়গায় বসে চন্দ্রকুমার একমনে বাবাকে ডাকতে লাগলো।
একসময় ছেলের ডাকে বাধ্য হয়ে চারদিক আলো করে চন্দ্রমাদেব এসে দেখা দিলেন। বাবাকে দেখেই চন্দ্রকুমার প্রণাম করলো।
এরপর হাতজোড় করে বাবাকে বললো –
“তুমি দেবতা, আমার বাবা। আমার মা আর আমি কত কষ্ট করে থাকি। তুমিতো ইচ্ছে করলেই আমার মায়ের কষ্ট দূর করতে পারো।”
চন্দ্রমাদেব বললেন–“তোমার মা তো আমার কাছে কিছুই চান না। তোমরা যদি চাও তবে সবকিছুই পেতে পার।”
চন্দ্রকুমার বললো –“বাবা আমি তোমার ছেলে হয়ে ব্যাঙ হয়ে আছি। খুব ভয়ে ভয়ে দিন কাটাই। আমি মানুষ হতে চাই।”
চন্দ্রমাদেব বললেন -“বাছা, তুমি আমারই ছেলে বটে। তবে কোনও এক দেবতার কারণে তুমি ব্যাও হয়ে জন্মগ্রহণ করেছে।
যদি কোনও নারী তোমাকে স্বামীরূপে বরণ করে নেয় তবেই তোমার রূপান্তর ঘটবে। আর সে-দিন খুব দূরে নয়।”
চন্দ্রকুমার বাবাকে বললো ওদের জন্য একখানা গীয়রিঙ (টংঘর) তুলে দিতে।
চন্দ্রমাদেব রাজী হলেন। তারপর যথারীতি চলে গেলেন। এদিকে বাড়ি ফিরে চন্দ্রকুমার কিন্তু বাবার সঙ্গে তার দেখা হওয়ার কথা মাকে বললো না।।
পরদিন ঘুম থেকে উঠেই চন্দ্রকুমার মাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল ওদের গৗয়রিঙের বারান্দায়।
ওরা দুজনেই দেখলো ওদের গৗয়রিঙ থেকে কিছুটা দূরেই পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে আরেকটা বিরাট গীয়রিঙ – সে যেন একটা রাজবাড়ি।
ঘরে প্রয়োজনীয় জিনিষ-পত্র সব সাজানো রয়েছে। গৗয়রিঙটা চন্দ্রকুমারের খুব পছন্দ হয়।
আর ওর মা ভাবলো, ওদের দুঃখ দেখে চন্দ্রমাদেব হয়তো দয়া করে নতুন গৗয়রিঙটা ওদের জন্য তুলে দিয়েছেন।
মা-ছেলে নতুন বাড়িতে উঠে এসেছে। একদিন চন্দ্রকুমার মাকে বললো – “মা আমাকে গৗয়রিও থেকে নামিয়ে দাও। আমি বাজারে যাবো।”
শুনে মায়ের বুক কেঁপে ওঠে। বাজারে যে অনেক লোক। এতোটুকু ছেলে।
মানুষের পায়ের চাপেই চেপ্টে যাবে।ওদিকে ছেলেও নাছোড়বান্দা। অগত্যা মা ছেলেকে নিচে নামিয়ে দিলো।
চন্দ্রকুমার থপ থপ করে চলে গেলো সেই জায়গাটিতে যেখানে বাবার সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল। আজও চন্দ্রমাদেবকে ডাকার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি এলেন।
বাবা আসতেই চন্দ্রকুমার তাকে বললো বাবা, তুমি যে বলেছিলে শীগিরই আমি মানুষ হবো। হাটে-বাজারে যেতে পারবো।
মানুষের ছেলেদের সঙ্গে খেলাধূলা করতে পিরবো। কই, আমি তো তা পারছিনা। সারাক্ষণ ব্যাঙ হয়ে থাকতে আমার ভারী খারাপ লাগে।’
চন্দ্রমাদেব ছেলেকে কোলে নিয়ে বললেন -“দুঃখ করিসূনে বাছা, তোকে আরও কিছুদিন ব্যাঙ হয়েই থাকতে হবে।
সময় হলেই তোর খোলসটা খসে পড়বে। তবে এখন থেকে যখনই ইচ্ছা হবে তখনই খোলসটা খুলে মানুষ হয়ে চলাফেরা করতে পারবি।
তবে মনে রাখিস কাজটা শেষ হওয়া মাত্রই আবার খোলসটা শরীরে এটে ব্যাঙ হয়ে কতে হবে।
আর একটি কথা, একাজটি কখনো কোনও মানুষের সামনে করবিনা।
চন্দ্রকুমার এতেই রাজি হল। বললো, বাবা তাহলে আমাকে এক্ষুনি কিছু টাকা ও একটা ঘোড়া দাও।
আমার খুব বাজারে যেতে ইচ্ছে করছে। আচ্ছা, আচ্ছা’ বলে চন্দ্রমাদেব হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন।
আর তখনই কোথেকে এক সুন্দর ঘোড়া সেখানে হাজির হলো। চন্দ্রকুমার গায়ের খোলসটি একটি গাছের রেখে ঘোড়ায় চড়ে বাজারে গিয়ে উপস্থিত হল।
কোনও রাজপুত্র এসেছে ভেবে লোকেরা অবাক হয়ে তাকে দেখতে লাগলো।
সে তাড়াতাড়ি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে সেই গাছের গোড়ায় ফিরে এলো।
তারপর আবার ব্যাঙের খোলসটি গায়ে এঁটে ঘোড়াটি চেপে থপ থপ করে গৗয়রিঙে ফিরে এলো। মাকে ডাকতেই মা বেরিয়ে এলো।
এতোসব জিনিস-পত্র দেখে মা তো খুব অবাক। তখন ছেলে বললো ‘পথে যেতে যেতে একজন লোকের সঙ্গে দেখা।
তিনি আমাকে কিছু টাকা দিলেন। সেই টাকা দিয়েই এসব কিনে আনলাম।
মা-ও ভাবলো, চন্দ্রমাদেবই ওকে টাকা দিয়েছেন। চন্দ্রকুমার যৌবনে পা দিয়েছে।
শুনেছে দূরে কোথায় এক বিরাট রাজবাড়ি আছে। সেখানে কত দালান কোঠা,কত লোকজন।
তারও ইচ্ছে হল রাজবাড়ি দেখতে যাবে। তাই মাকে একদিন বললো –
‘আমি রাজবাড়ি দেখতে যাবো মা। আমাকে গৗয়রিঙ থেকে নামিয়ে দাও।
মা তো শুনে ভয়ে কাঠ হবার জোগাড়। ছেলেকে কোলে নিয়ে বললো সে তো অনেক দূর বাবা।
অনেক পথ হেঁটে যেতে হয়। পথও ভালো নয়। পথে কত সান্ত্রী-সেপাই। ওখানে যাসনা বাবা।
ছেলেও দমবার পাত্র নয়। সে মাকে বুঝিয়ে বললো, তুমি ভয় পেয়োনা।
আমি চন্দ্রদেবের ছেলে। কেউ আমার কোনও ক্ষতি করতে পারবেনা। আমি ঠিক ঘুরে ফিরে চলে আসবো।
মা ছেলেকে গীয়রিঙ থেকেনামিয়ে দিয়ে আদর করে বললো, দেখিস বাছা সাবধানে যা। বিপদে পড়লে তোর বাবাকে ডাকি।
ছেলে থথপ করে এগিয়ে চললো। কিছুদূর গিয়েই সে বাবাকে ডাকলো। ডাকার সঙ্গে সঙ্গেই চন্দ্রমাদেব এসে ছেলেকে দেখা দিলেন।
চন্দ্রকুমার বাবার কাছ থেকে একটি সুন্দর ঘোড়া ও একপ্রস্থ রাজার ছেলের পোষাক চেয়ে নিল।
এরপর মানুষরূপ ধারণ করে ব্যাঙের খোলসটি গাছের গর্তে লুকিয়ে রাখলো। ঘোড়ায় চড়ে চন্দ্রকুমার চললো রাজবাড়ির দিকে।
পাহাড় জঙ্গল পেরিয়ে চন্দ্রকুমার রাজধানীর কাছে গিয়ে পৌঁছোলো।
ঘোড়ায় চড়ে গেলে যদি লোকের নজর পড়ে যায় তাই ঘোড়াটিকে জঙ্গলে লুকিয়ে রেখে চন্দ্রকুমার পায়ে হেটেই রাজবাড়ির দিকে এগিয়ে চললো।
সারাদিন সে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ালো। দেখা যেন আর শেষই হয়না।
রাজার হাতীশালে কত হাতী ঘোড়াশালে কত ঘোড়া, কত সেপাই-সান্ত্রী, কত দাস-দাসী।
সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। এখানে সেখানে কত দালান। বিকেলে চন্দ্রকুমার এলো রাজবাড়ির সরোবরের পাশে।
সরোবরের মাঝখানে এক জলটুঙ্গী ঘর। সেখানে রোজ বিকেলে রাজকন্যা হাওয়া খায়।
সেদিনও বিকেলে রাজকন্যা হাওয়া খাচ্ছিল। জলটুঙ্গী ঘর থেকে রাজকন্যা চন্দ্রকুমারকে দেখলো।
তার রূপ দেখেই রাজকন্যা মজে গেল।দাসীকে পাঠিয়ে সেচন্দ্রকুমারকে ডেকে পাঠালো।
দাসীর সঙ্গে চন্দ্রকুমার জলটুঙ্গি ঘরে উঠে এলো। দুজন দুজনকে দেখলে। দুজনেই দুজনের রূপে মুগ্ধ হল। দুজন দুজনকে ভালোবাসলো।
সন্ধ্যে হয়ে আসছিলো। চন্দ্রকুমার রাজকন্যার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সেদিনের মতো বাড়ি ফিরে গেল।
তারপর থেকে রোজই চন্দ্রকুমার আর রাজকন্যার দেখা হতে লাগলো।
কোন দিন জলটুঙ্গী ঘরে, কোনদিন রাজার ফুলবাগানে।
একদিন রাজকন্যা চন্দ্রকুমারের পরিচয় জানতে চাইলো। সে অকপটে তার। জীবনকাহিনী শোনালো।
তার মায়ের দুঃখের কাহিনী, চন্দ্রমাদেবের ছেলে হয়েও ব্যারূপে তার জন্মানোর কথা — সবই বললো। এসব শুনে তো রাজকুমারী অবাক।
মানুষের ঘরে কি কখনো ব্যাঙ জন্মাতে পারে? চন্দ্রকুমার বললো
“তোমার বিশ্বাস না হলে আমি কাল তোমার কাছে ব্যাঙ রূপ নিয়েই আসবো। আমাকে তখন তুমি ঘৃণা করবে না তো?’রাজকুমারী বললো
‘ঘৃণা কেন করব? আমি যাকে ভালোবেসেছি, যাকে স্বামীরূপে মনে মনে বরণ করে নিয়েছি – সে সাপ হোক, ব্যাঙ হোক আমার স্বামীই।’
কুমার হেসে বললো-“দেখা যাবে।
পরদিন চন্দ্রকুমার লাফিয়ে লাফিয়ে রাজকন্যার কাছে গিয়ে বললো, দেখো রাজকন্যা তোমার স্বামী এসেছে, এবার তাকে বরণ করে নাও দেখি।’ বলেই সে নাচতে লাগলো।
রাজকন্যা চেয়ে দেখলো তার কাছেই একটি সোনাব্যাঙ নেচে নেচে কথা বলছে। সে তখন ব্যাঙকে কোলে নিয়ে আদর করতে লাগলো।
কিছুক্ষণ পর চন্দ্রকুমার জঙ্গলে গিয়ে আবার মানুষের রূপ ধরে রাজকন্যার কাছে হাজির হল।
জিজ্ঞেস করলো “কি গো রাজকুমারী, তোমার সোনাব্যাঙ রাজকুমারকে দেখলে তো?ভয় পেয়োনা, বাবা বলেছেন, যদি কোন রাজকুমারী আমাকে পতিরূপে বরণ করে নেয় তবেই আমার উপর দেবতার কোপ কমে যাবে।
আমার খোলসটিও চিরদিনের জন্য খসে যাবে। আমি সবসময় মানুষের রূপ ধরে থাকতে পারবো।
এদিকে সারাদিন আনমনা হয়ে কিসব ভেবে দেখে ছেলের জন্য মনে খুব ভাবনা জাগে কুফুরের। একদিন ছেলেকে তাই জিজ্ঞেস করে
তোর কোনও অসুখ বিসুখ করে নি তো বাবা! সবসময় এতো আনমনা থাকিস কেন বলতো?
ছেলে বললো- আমার কোনও অসুখ করেনি। আমার খোলসটি কখন খসবে, তা-ই শুধু ভাবি।
ওদিকে রাজরাণীও রাজকন্যাকে নিয়ে মহাবিপদে পড়েছেন। নাম গোত্রহীন কোন এক ছেলেকে রাজকন্যা ভালোবাসে বলে খবর পেয়েছেন।
একদিন ওরা আড়াল থেকে সেই ছেলেটির সঙ্গে রাজকুমারীকে গল্প করতেও দেখেছেন। দেখে শুনে তো মনে হল কোনও রাজকুমারই হবে।
তাই একদিন রাজা বুড়ো মন্ত্রীকে পাঠালেন ছেলেটির খবরা খবর নিতে।
রাজবাড়ি থেকে যেদিন লোকজন নিয়ে মন্ত্রী এলো, চন্দ্রকুমার তার সামনে না এসে লুকিয়ে রইলো।
মাকে বললো, ‘আমার খোঁজ করলে বলবে চন্দ্রকুমার বাড়িতে নেই।”
চন্দ্রকুমারের বাড়ি ঘরদোর দেখে মন্ত্রীর খুব পছন্দ হল। কুফুরও তাদের খুব ভালো করে খাইয়ে-দাইয়ে দিল।
ওরা খুব খুশী হল। রাজবাড়িতে ফিরে ওরা যেমন দেখলো সব বললো। সব কিছু শুনে রাজা চন্দ্রকুমারের সঙ্গেই রাজকুমারীর বিয়ে দিতে মনস্থ করলেন।
রাজকন্যার বিয়ে। রাজবাড়িতে মহা ধুমধাম পড়ে গেল। নাচ-গান, খাওয়া-দাওয়ার বিরাম নেই। বিয়ে দেখতে কত লোক যে এলো।
বিয়ের দিন রাজকুমারীকে সাজানো হল বিয়ের সাজে। রাজবাড়ির উঠোনে সুন্দর করে বেদী সাজানো হল।
হাতি, ঘোড়া সাজিয়ে একদল লোক চলে গেল বর আনতে। কখন বর আসবে সবাই পথ চেয়ে বসে আছে। এক সময় হাতির পিঠে চড়ে বর এলো।
সবাই এগিয়ে গেল বর দেখতে। ওমা, বর কোথায় ? হাতির পিঠে বরের সাজে বসে আছে মস্ত বড় এক সোনাব্যাঙরাজার জামাই কিনা সোনাব্যাঙ।
সবাই দুয়ো দুয়ো করে যে যার মতো চলে গেল। রাজারাণীও লজ্জায় সেই যে ঘরে ঢুকে খিল দিলেন, আর বেরোলেন না।
ওদিকে রাজকুমারী মালা হাতে এগিয়ে গেল পতি বরণ করতে। চন্দ্রকুমারও হাতির পিঠ থেকে একলাফে নেমে এলো।
রাজকন্যা সোনাব্যাঙকেই প্রণাম করে গলায় মালা পরিয়ে দিল। দুজনের বিয়ে হয়ে গেল।
এবার বাড়ি যাবার পালা। ব্যাঙরূপী চন্দ্রকুমার বৌ নিয়ে নেচে নেচে এগিয়ে গেল। বাড়ির দিকে। গাঁয়ে এসে সে গান গাইতে লাগলো –
শাঁখ বাজে বাদ্যি বাজে।
আরও বাজে ঢাক তা ডুমাডুম, ধিনাক ধিনা
তাক ডুমাডুম তাক। চাঁদের ছেলে বিয়ে করে
রাজকন্যা এক কে দেখবে দেখতে এসো
তাক ডুমাডুম তাক।
গান শুনে গাঁয়ের ছেলে বুড়ো সবাই বর-বৌ দেখতে ছুটে এলো। কুফুর খুব আদর করে ছেলে বৌকে বরণ করলো।
চন্দ্রকুমার আর রাজকন্যা দুজনেই সুখে দিন কাটাচ্ছে। তবে এখনও চন্দ্রকুমারের খোলসটি খসেনি।
তাই সে দিনের বেলায় ব্যাঙ হয়ে থাকে আর রাতে ঘুমোত যাবার আগে খোলসটি খুলে লুকিয়ে রাখে।
একদিন রাতে চন্দ্রকুমার ঘুমিয়ে আছে। এমন সময় রাজকুমারী খোলসটি পোড়াতে যাবে অমনি তার ভিতর থেকে মানুষের স্বরে কেউ কথা বলে উঠলো।
বললো,’রাজকন্যা আমি নছুমৗতায় (গৃহদেবতা)। আমার পূজা যাতে প্রচার হয় তার জন্যই এতোদিন আমি চন্দ্রকুমারের শরীর জড়িয়ে ছিলাম।
তুমি আমার পূজার ব্যবস্থা কর, তোমাদের মঙ্গল হবে।
রাজকন্যা বললো, তোমার পূজা দিলে কি কি মঙ্গল হবে তোমার অধিষ্ঠানই বা কোথায় হবে বলে দাও’।
তখন দেবতা বললেন ঘরের এক কোণায় হবে আমার অধিষ্ঠান। আমাকে পূজা
দিলে অপদেবতারা গৃহস্থের কোনও অমঙ্গল করতে পারবেনা। আমি ঘর-দোর পাহারা দিয়ে গৃহস্থকে রক্ষা করে থাকি।
রাজকন্যা বললো – ‘বেশ তাহলে তাই হবে, আমি তোমার পূজার ব্যবস্থা করছি।
খোলস থেকে রাজকন্যা হাতের বাধন কিছুটা আলগা হতেই নছু মীতায় ছায়ার মতো হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।
রাজকন্যা খোলসটি আগুনে ফেলতেই এদিকে রাজকুমার ভীষণ জ্বালায় চিৎকার দিয়ে জেগে উঠলো। রাজকন্যা তাকে পাখা দিয়ে বাতাস করতে লাগলো।
কুফুরতি দৌড়ে এলো ঘর থেকে। সে এসে কিছুটা গোবর ছেলের গায়ে লেপে দিলো। এতে চন্দ্রকুমারের শরীর ঠান্ডা হল।
আরাম পেয়ে সে শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লো। মা ছেলের মানুষরূপ। দেখে আহ্লাদে আধখানা হয়ে গেল।
এদিকে কুফুরতির মামা-মামীও বুড়ো হয়ে গেছে। তারাও কুফুর এর সঙ্গে থাকে। চন্দ্রকুমারের ব্যবহারে গাঁয়ের সবাই খুশী।
লজ্জায় রাজারাণী এতো দিন মেয়ের খবর নেননি। এবার লোকমুখে চন্দ্রকুমারের সুখ্যাতি শুনে তাঁরা মেয়ে-জামাইকে আনতে লোক পাঠালেন।
ওরা এলে ওদের দেখে রাজারাণী দুজনেরই খুব আনন্দ হল। একদিন রাজা চন্দ্রকুমারকে বললেন –
বাবা-আমার তো ছেলে নেই। তুমিই আমার ছেলে। তোমার হাতেই আমি রাজ্যভার তুলে দিচ্ছি। এখন থেকে তুমিই রাজ্যপাট দেখবে। প্রজাদের লালন পালন করবে।
খুব জাকজমক করে চন্দ্রকুমার সিংহাসনে বসলো। সেদিন তার মা, আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী সবাই এলো, স্বয়ং চন্দ্রমাদেব এসে ছেলেকে আশীর্বাদ করে বললেন
‘বস, আজ থেকে তুমি চন্দ্রবংশীয় রাজা বলে পৃথিবীতে পরিচিত হবে। তোমার বংশের রাজাগণ যুগ যুগ ধরে গৗরবের সঙ্গে প্রজাপালন করবে।
যাবার আগে চন্দ্রমাদেব চন্দ্রকুমারকে একটি অর্ধচন্দ্রবাণ দিয়ে গেলেন।
চন্দ্রকুমার সিংহাসনে বসার কিছুকাল পরই বুড়ো রাজারাণী নির্জনে ভগবানকে ডাকার জন্য মনু নদীর তীরে একপর্বতে চলে গেলেন।
চন্দ্রকুমার প্রজাদের সন্তানের মতো লালন পালন করতে লাগলো। তাই প্রজারা তাকে ফা’ (পিতা) বলে ডাকতো।
তথ্যসূত্র: ত্রিপুরার আদিবাসী লোককথা