
সকল শোষণমূলক ও পিতৃতান্ত্রিক সমাজের ন্যায় চাকমা সমাজে ও নারীর অবস্থান পুরুষের সমমর্যাদার নয়। এখনো অনেক পরিবারে নারীদের কেবল বুনন, রান্নাবান্না, সন্তান লালনপালন ও গৃহস্থালির কাজের উপযোগী বলে বিবেচনা করা হয়।
পারিবারিক ও সামাজিক বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে পুরুষের প্রাধান্য নারীর চেয়ে অনেক বেশি। শিক্ষা ও চাকুরির ক্ষেত্রেও নারীর অংশগ্রহণ বা সুযোগের হার পুরুষের চেয়ে কম।
তবে বিভিন্ন বৈষম্য সত্ত্বেও চাকমা সমাজে নারীদের গুরুত্ব দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৈষম্যমূলক অনেক প্রাচীন প্রথা ধীরে ধীরে অপসৃত হচ্ছে। বিভিন্ন পেশায় ও সংস্থায়ও নারীর অংশগ্রহণ গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হচ্ছে (সজীব চাকমা, বাংলাদেশের আদিবাসী, ২০১০)।
তবে কোনো কোনো চাকমা পরিবারে এখনো কন্যার চেয়ে পুত্রসন্তান বেশি কাঙ্কিত। চাকমা সমাজে গর্ভবতী নারীর নিজের স্বামীর ঘরে বা স্বামীর গোষ্ঠীভুক্ত কারো ঘরে সন্তান প্রসব করার রীতি আছে।
চাকমা সমাজকাঠামো মূলত পিতৃতান্ত্রিক এবং নিজস্ব প্রথা ও রীতিনীতিনির্ভর। চাকমাদের সংস্কার, ধর্মবিশ্বাস, লোকাচার ইত্যাদিতে নারীর অধস্তনতার চিত্র ফুটে ওঠে; যেমন, আগেকার দিনে চাকমাদের মধ্যে প্রচলিত বিশ্বাস ছিল যে, কোনো ফলবতী বৃক্ষে নারী চড়লে সে বৃক্ষের ফল পোকায় কাটে।
কোনো নারীর পরিধেয় বস্ত্র মেলে দেওয়া দড়ির নিচ দিয়ে চলাফেরা করলে পুরুষের তেজ কমে যায়। নারী সরাসরি নির্বাণ লাভ করতে পারে। সেজন্য আগে পুরুষ হয়ে জন্ম নিতে হয়। অনেক পুণ্যের ফলে পুরুষজন্ম লাভ করা যায় ইত্যাদি।
চাকমা সমাজে নারীর ওপর সহিংসতার মাত্রা কম। যৌতুক নিয়ে নির্যাতন, অ্যাসিড নিক্ষেপ, স্ত্রীকে খুন, ধর্ষণ ইত্যাদি চাকমা সমাজে তুলনামূলকভাবে কম দেখা যায় । তারপরও নানাভাবে নানা মাত্রায় নারীর ওপর সহিংসতা বিদ্যমান।
নারীকে গালিগালাজ, কখনো কখনো মারধর, পরিশ্রমের ভার চাপিয়ে দেয়া, ইত্যাদি নিপীড়ন অনেক চাকমা নারীকে ভোগ করতে হয়। এ জাতীয় নির্যাতন সাধারণত অভাব-অনটনগ্রস্ত পরিবার ও মাতাল স্বামীর ঘরে বেশি দেখা যায়।
চাকমা উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী পিতৃসম্পত্তিতে নারীর কোনো অধিকার থাকে না। কেবল পিতা বা স্বামী কর্তৃক দান হিসেবে প্রাপ্ত সম্পত্তির ওপরই তার অধিকার রয়েছে। কোনো ব্যক্তি তার নামে উইল করে গেলে সে সম্পত্তির ওপর নারীর অধিকার থাকে।
আধুনিক যুগে চাকুরিজীবী বা উপার্জনকারী নারী নিজ প্রচেষ্টায় কোনো অর্থ বা সাত অর্জন করলে সেই অর্থ বা সম্পত্তির ওপর তার অধিকার রয়েছে বলে মেনে নেয়া হয়।
চাকমা জনগোষ্ঠীর বিবাহবিচ্ছেদ, সন্তানের ভরণপোষণ ও সন্তানের অভিভাবকত্ব, উত্তরাধিকার ইত্যাদি ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয়ে বিরোধ দেখা দিলে সামাজিক অনুসারে রাজা/হেডম্যান/কার্বারি কর্তৃক পরিচালিত প্রথাগত আদালতে নিষ্পত্তি হয়ে থাকে। চাকমাসহ অন্যান্য আদিবাসীদের প্রথাগত আইন ক্ষেত্রবিশেষে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক।
চাকমা সমাজে বিয়ে একটি সামাজিক অনুষ্ঠান। চুমুলাঙ, জদনবানাহ, খানা সিরান ও বিষদ ভাঙা- এই চারটি অবশ্যপালনীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একটি চাকমা বিয়ে প্রথাসিদ্ধ হয় বা শুদ্ধতা লাভ করে।
চাকমারা বৌদ্ধ ধর্মালম্বী হলেও ধর্মীয় রীতিনীতির সাথে বিয়ের সামাজিক অনুষ্ঠানাদির তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। বিয়ের এইসব অনুষ্ঠানাদির মূল উদ্দেশ্যে হলো এক জোড়া নর-নারীর সমাজসিদ্ধভাবে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বসবাসের লক্ষ্যে সমাজের অনুমোদন লাভ করা।
চাকমা সমাজে বিয়ে নিবন্ধনের কোনো রীতি নেই। বিয়েতে উপস্থিত সমাজপতি, গণ্যমান্য ব্যক্তি ও সমাজের আমন্ত্রিত ব্যক্তিরাই চাকমা বিয়ের সাক্ষী ও অনুমোদনকারী।
চাকমা সমাজে একজন নারী বিয়ের পর তার পিতার পরিবার ছেড়ে স্বামীর সংসারে এসে পিতৃপ্রদত্ত উপাধির পরিবর্তে স্বামীর উপাধি গ্রহণ করেন।
চাকমা সমাজে সাধারণত দুই ধরনের বিয়ের প্রচলন দেখা যায় : ১. সামাজিক/নিয়মিত বিয়ে ও ২. পলায়ন/অনিয়মিত বিয়ে। এছাড়াও সমাজে বহুবিবাহের প্রচলন রয়েছে। বিধবাদের বিয়ের ক্ষেত্রে কোনো বিধি-নিষেধ নেই।
বিয়ের ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ সম্পর্ক : চাকমা সমাজে একই গোত্রের (গুত্থি) একই রক্তের মধ্যে সাত পুরুষ (প্রজন্ম) পর্যন্ত বিয়ে নিষিদ্ধ। বর্তমানে এটি পাঁচ পুরুষে শিথিল করা হয়েছে। এই প্রথা অনুসারে আপন কাকাত বা জেঠাত ভাই-বোন, একই পিতার ঔরসজাত সৎ ভাইবোন এর মধ্যে বিয়ে হতে পারে না।
এছাড়া চাকমাদের ‘গরবা কুদুম’-এর মধ্যে বিয়ে হতে পারে না; যেমন কাকা-ভাইঝি, পিসি-ভাইপো, মামা-ভাগিনী, মাসি-ভাগিনা ইত্যাদি। সাধারণত, অসমবয়সীদের মধ্যে। বিয়ে মেনে নেয়া হয় না, যদিও এর ব্যতিক্রম দেখা যায়।
পলায়ন বিয়ে বা ধাবা মান্যর ক্ষেত্রে যুবক-যুবতী অভিভাবকের অজ্ঞাতে পালিয়ে গিয়ে কোনো পরিচিত বা আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেয়।
ঘটনা জানাজানি হয়ে গেলে সাধারণত ছেলেপক্ষ মেয়েপক্ষের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে বিষয়টি নিষ্পতির উদ্যোগ নেয়। যদি ছেলে ও মেয়ের বিয়ে ‘গরবা কুদুম’ বা নিষিদ্ধ সম্পর্কভুক্ত না-হয় এবং মেয়ের পিতা-মাতার দাবি-দাওয়া (দাভা) ছেলেপক্ষ মেনে নেয়, তাহলে সমাজের অনুমোদন সাপেক্ষে পলাতক যুগলের বিয়ে বৈধতা লাভ করে।
তবে যুবক-যুবতী বাড়ি ছেড়ে পালিত সময় যদি কোনোভাবে মেয়েপক্ষের কারো কাছে ধরা পড়ে, তাহলে মেয়েকে তার , কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়। আর যদি প্রেমিকযুগল কোনো ভাবে পাত্রের বাড়িতে পৌছে যায় তাহলে পাত্রী সেই বাড়ির বউ হিসেবে সমাজে স্বীকৃতি লাভ করে।
তবে প্রেমিক-প্রেমিকার বিয়ে নিষিদ্ধ সম্পর্কের আওতাভুক্ত হলে, তা কখনোই সমাজ অনুমোদিত বা বৈধ হয় না।
এ ধরনের পলায়নের পর প্রেমিক যুগলকে সামাজিক আদালতে বিচারের সম্মুখীন হতে হয়। পলাতক অবস্থায় বিয়ে-বহির্ভূতভাবে দৈহিক মিলনের অপরাধে সামাজিক আদালতের রায় অনুযায়ী তাদের শুকর, মোরগ, মদ ও নগদ টাকা জরিমানা দিতে হয়।
চাকমা সমাজে বিয়ের ক্ষেত্রে কন্যার অভিভাবক হিসেবে পিতার একচ্ছত্র বা নিরষ্কুশ অধিকার লক্ষ করা যায়। বিশেষত, গ্রামীণ সমাজব্যবস্থায় বিয়ের সম্বন্ধের ক্ষেত্রে পাত্রী/কন্যার মতামতের চেয়েও কন্যার পিতার মতামত প্রথানুযায়ী গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়ে আসছে।
পালিয়ে গিয়ে বিয়ের ক্ষেত্রেও প্রেমিকা বা মেয়ের পিতা যদি প্রেমিকের সাথে মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি না-হয় কিংবা মেয়ের পিতার দাবি অনুযায়ী কনেপণ (দাভা) ও অন্যান্য দাবি পূরণে যদি পাত্রপক্ষ সমর্থ বা রাজি না-হয়, তাহলে মেয়েকে সেই পাত্র/প্রেমিকের সাথে বিয়ে না-দিয়ে নিজ বাড়িতে ফিরিয়ে আনার অধিকার পিতার রয়েছে।
একজন পিতা এভাবে প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়ে যাওয়া তার কন্যাকে প্রথামতো পর পর তিনবার পর্যন্ত নিজ হেফাজতে ফেরত পাবার অধিকারী।
কন্যা যদি চতুর্থবারের মতো আর প্রেমিকের সাথে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করতে সক্ষম বা ইচ্ছক হয়, তাহলে সেই পিতা আবাস তার কন্যাকে নিজ হেফাজতে ফেরত পাবার অধিকার হারিয়ে ফেলে।
বর্তমান চাকমা সমাজে ধামান্য বিয়ের পরিবর্তে নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে হলফনামা নিজেদের স্বামী-স্ত্রীরূপে ঘোষণার প্রবণতা দেখা যায়, যা প্রচলিত ভাষায় কোর্ট ম্যারেজ নামে পরিচিত। তবে এই ধরনের কোর্ট ম্যারেজ বা বিয়ে চাকমা সমাজে প্রথাসিদ্ধ নয়।
সম্বন্ধ করে হওয়া সামাজিক বিয়েতেও পাত্র-পাত্রীর সম্মতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের বেলায় বা পুরুষ অভিভাবকের মতামত প্রাধান্য পায়। বিয়েতে আমন্ত্রিত অতিথিদের তালিকারও গ্রামাঞ্চলের গণ্যমান্য ব্যক্তি তথা হেডম্যান, কার্বারিসহ পুরুষের প্রতিনিধিত্ব থাকে বেশি ।
দাভাপ্রথা (কনেপণ): চাকমা সমাজে বিয়েতে যৌতুকপ্রথা নেই, বরং দাভাপ্রথা (কনেপণ) রয়েছে। দাভা হলো কনেপক্ষ বা কনের পিতা কর্তক বরপক্ষের কাছে দাবিকৃত পণ, যা বিয়ের চুড়ান্ত দিনক্ষণ ঠিক করার আগে নির্ধারণ করা হয়।
দাভা হিসেবে সাধারণত নগদ টাকা, কয়েক মণ চাউল, শুকর বা মহিষ, কনের বিয়ের অলংকারাদি ও পোশাক ইত্যাদি দাবি করা হয়। উভয়পক্ষের আলোচনার মাধ্যমে দাভার পরিমাণ নির্ধারণ করা হয় এবং তা বিয়ের নির্ধারিত তারিখের কয়েক দিন আগে পাত্রীর পিতার কাছে পেীছে দিতে হয়।
কনের পিতার দাবি অনুযায়ী পাত্রপক্ষ সাভা দিতে না-পারলে বা সাভার পরিমাণ নিয়ে কনের পিতার সাথে বনিবনা না-হলে তিনি কন্যাকে ওই পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দিতে অসম্মতি জানাতে পারেন।
কনের জন্য বিয়ের অলংকার ও পোশাকাদি ব্যতীত দাভার নগদ টাকা, চাল, শূকর, মদ ও অন্যান্য সামগ্রী সম্পূর্ণ কনের পিতা বা তার অভিভাবকের প্রাপ্য।
বর্তমানে শহরে বসবাসকারী শিক্ষিত চাকমাদের বিয়েতে দাভার প্রচলন প্রায় নেই বললেই চলে। তবে গ্রামাঞ্চলে এখনো এই প্রথার ব্যাপক প্রচলন লক্ষ করা যায়।
বহুবিবাহ: চাকমা সমাজে সাধারণত এক স্বামী ও এক স্ত্রী প্রথা প্রচলিত। এক স্বামী ও একাধিক স্ত্রীর পরিবারও সমাজে রয়েছে। সমাজে অবৈধ না-হলেও একে স্বাভাবিক হিসেবে গণ্য করা হয় না। এই প্রথা ব্যতিক্রমী হিসেবে সমাজে অত্যন্ত নগণ্য বলা যায়। চাকমা সমাজে বিধবা বিবাহ অনুমোদিত।
চাকমা সমাজে একজন পুরুষ একই সাথে ঠিক কতজন স্ত্রীর সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক বজায় রাখতে পারে, এরূপ কোনো সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত প্রথাগত আইনে উল্লেখ নেই। এ পর্যন্ত একজন পুরুষের একই সাথে ৩/৪ জন স্ত্রী রাখার নজির চাকমা সমাজে দেখা গেছে।
একজন বিবাহিত চাকমা পুরুষ এক স্ত্রী বর্তমান থাকা অবস্থায় যে সমস্ত কারণে দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করতে পারেন, তা হলো:
কি উপযুক্ত কারণগুলো ছাড়াও কোনো যৌক্তিক কারণ ব্যতীত একজন চাকমা পুরুষ বহুবিবাহ করতে পারেন। সেক্ষেত্রে বিবাহিত পুরুষের বর্তমান স্ত্রী বা স্ত্রীদের সম্মতিও কোনো প্রয়োজন হয় না। এক্ষেত্রে চাকমা সমাজের প্রচলিত ধারণা হলো – খাওয়াতে (ভরণপোষণ করতে) পারলে একাধিক বিয়ে করা যায়।
অন্যদিকে, উল্লিখিত কারণে বা কোনো অবস্থায়ই একজন বিবাহিত নারী বিবাহবিচ্ছেদ ব্যতীত দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করতে পারেন না। এক্ষেত্রে বড়োজোর স্ত্রী বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন করতে পারেন বা বিবাহবিচ্ছেদের অধিকার পান।
মিশ্র বিয়ে: চাকমা সমাজে কোনো চাকমা নারী যদি কোনো ভিন্ন জাতি বা সম্প্রদায়ের কোনো পুরুষকে বিয়ে করেন, তাহলে তা ভিন্নভাবে দেখা হয়। ভিন্ন আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর কোনো পুরুষকে বিয়ে কিছুটা গ্রহণ করা হলেও অনাদিবাসী জাতিগোষ্ঠী কাউকে বিয়ে করলে কখনো তা মেনে নেয়া হয় না।
অপরদিকে কোনো চাকমা পুরুষ যদি কোনো ভিন্ন জাতি বা সমপ্রদায়ের নারীকে বিয়ে করেন, তাহলে সমাজ সেই মাঠ সহজেই গ্রহণ করে। যদিও এ ধরনের মিত্র বিয়ে চাকমাদের মধ্যে সংখ্যায় তেমন উল্লেখযোগ্য নয়।
বিবাহবিচ্ছেদ: চাকমা সমাজে বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে কিছু সাধারণ কারণ/ক্ষেত্র তবে পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় পুরুষের ওপর নারীর নির্ভরশীলতার কারণে বিচ্ছেদের ফলে প্রায়শই নারী ন্যায়বিচার ও ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হন।
যে সকল ক্ষেত্রে একজন চাকমা স্বামী বা স্ত্রী সাধারণত বিবাহবিচ্ছেদ বা সরকাগজ করতে পারেন, তা নিমরূপ (বিচ্ছেদপত্রকে চাকমা ভাষায় ‘সুরকাগজ’ বলে) :
উল্লিখত কারণসমূহের ফলে স্বামী বা স্ত্রীর পরস্পরের প্রতি বিবাহবিচ্ছেদের অধিকার জন্মালেও চাকমা সমাজের বাস্তব চিত্র ভিন্ন; যেমন স্ত্রী গর্ভধারণ বা সন্তান জন্মদানে অক্ষম হলে স্বামীকে সাধারণত দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ বা বিবাহবিচ্ছেদ ঘটাতে দেখা যায়।
কিন্তু যদি সন্তান জন্মদানে অক্ষম হন, তাহলে স্ত্রী সাধারণত স্বামীকে পরিত্যাগ করেন না । অনেক ক্ষেত্রে দত্তক গ্রহণ করেন। অথচ কেবল গর্ভধারণে অক্ষমতা নয়, এমনকি পুত্রসন্তান জন্ম দিতে না-পারার কারণেও কোনো কোনো চাকমা পুরুষকে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটাতে বা দ্বিতীয় বিয়ে করতে দেখা যায়।
স্বামীর একাধিক বিয়ে, অহেতুক সন্দেপ্রবণতা, স্ত্রীর প্রতি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, পরকীয়া প্রেমে আসক্তি, ভরণপোষণ না-দেয়া, ইত্যাদির কারণে স্বামীর কাছ থেকে স্ত্রীর বিবাহবিচ্ছেদ পাওয়ার বিধান থাকলেও সমাজের নিরাপত্তাহীনতা, আর্থিক দৈন্য, সহায় সম্বল না-থাকার কারণে অনেক নারী স্বামীকে ছেড়ে যেতে চান না এবং অনেক ক্ষেত্রে সতিনের সাথে স্বামীর ঘর করতে বাধ্য হন।
এক্ষেত্রে কেবল শিক্ষিত স্বাবলম্বী নারীদের স্বামীর বিরুদ্ধে বিচ্ছেদ চেয়ে সামাজিক বা প্রচলিত আদালতের দ্বারস্থ হতে দেখা যায়। পুরুষধিপত্যপূর্ণ চাকমা সমাজে একজন পুরুষের পক্ষে তার স্ত্রীকে তালাক দেয়া যতটা সহজ, একজন চাকমা নারীর পক্ষে ততটা সহজ নয়।
উপরে উল্লিখিত বিশেষ কারণগুলো ছাড়াও যেকোনো কারণে কোনো পুরুষ তার স্ত্রীকে তালাক দিতে চাইলে কেবল স্বামীর নির্দেশ মেনে না-চলা বা স্বামীর অবাধ্য হওয়ার অজুহাতেই স্ত্রীকে সুরকাগজ দিতে পারেন। তাছাড়া নারীর চরিত্রকে কলঙ্কিত করার ঘটনাও সমাজে হরহামেশাই ঘটছে।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্ত্রী ও সন্তানকে ভরণপোষণের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা বা দ্বিতীয় বিয়ে করার জন্য স্ত্রীকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়, যাতে স্ত্রী বিবাহবিচ্ছেদ চাইতে বাধ্য হন।
কোনো পুরুষ স্ত্রীকে তালাক দিতে চাইলে কয়েকজন লোকের (সাক্ষীর) স্বাক্ষরযুক্ত সুরকাগজ স্ত্রীর বরাবরে সম্পাদন করে দিলেই হয়ে যায়, যদি স্ত্রী তা মেনে নেন।
অন্যদিকে, একজন স্ত্রী যৌক্তিক কারণে তার স্বামীর সাথে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটাতে চাইলেও তাকে অবশ্যই সামাজিক আদালতের দ্বারস্থ হতে হয় এবং স্বামীর বিরুদ্ধে বিচ্ছেদ চাওয়ার কারণ প্রমাণ করতে হয়।
স্বামীর দোষে বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে বোয়ালী সামগ্রী হিসেবে স্বামীর কাছ থেকে প্রাপ্ত যাবতীয় অলংকার ও পোশাক স্ত্রী ফেরত পান। এক্ষেত্রে স্বামীর কোনো দাবি থাকে না।
স্ত্রীর দোষে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটলে বিয়েতে স্বামীর কাছ থেকে দাভা বা বোয়ালী হিসেবে পাওয়া যাবতীয় অলংকার ও পোশাক প্রথামতে স্বামীর কাছে ফেরত দিতে হয় এবং বিয়ের ৩ মাস থেকে ১ বৎসরের মধ্যে বিচ্ছেদ হলে বিয়ের সম্পূর্ণ বা আংশিক খরচ স্বামী ফেরত পেতে পারেন।
চাকমা জনগোষ্ঠীর আদি পেশা বা জীবিকার প্রধান উৎস জুমচাষ। যুগ যুগ ধরে আদিবাসী চাকমারা বংশপরম্পরায় জুমচাষ করে আসছে। জুমচাষের জন্য জমির কোনো একক মালিকানাস্বত্বের প্রয়োজন হয় না।
১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধিমতে, প্রথাগত আইনের আওতায় সমষ্ঠিগত মালিকানা হিসেবে ভূমি ও প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের ফলে চাকমা সমাজে স্থাবর সম্পত্তি, বিশেষত ভূমির স্থায়ী মালিকানাস্বত্ব অতীতে তেমন একটা গড়ে ওঠে নি।
যদিও পরবর্তী সময়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জুমচাষের অন্য জমির অঙ্গ অপ্রতুলতা, লাঙল চাষ ও উদ্যানকৃষির প্রতি মনোযোগ বৃদ্ধি ও বংশপরম্পরায় একই ভনিত, কারণে চাকমা সমাজে ভূসম্পত্তির ওপর স্থায়ী মালিকানা স্বত্ব অর্জনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
চাকমা পরিবারে উত্তরাধিকারযোগ্য সম্পত্তি অনের পর সম্পত্তির মালিতের মা সম্পত্তি তার উত্তাধিকারীদের মধ্যে ভাগ-বণ্টনের প্রয়োজনে চাকমা সমাজে উত্তাধিকারপ্রথায় উস্তব ও প্রচলন ঘটে। চাকমা নারীরা পরিবারের প্রধান চালিকাশুক্তি।
স্নরণতীত কাল থেকে চাকমা নারীরা জুমে, জমিতে, ঘরে-বাইরে পুরুষের পাশাপাশি শ্রম দিয়া এবং গৃহস্থালি কাজে অক্লান্ত পরিশ্রম করে পরিবারকে দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ রাখলেও চাকমা সমাজের উত্তরাধিকার নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক।
চাকমা সমাজের উত্তরাধিকারের সাধারণ নীতি নিম্নরূপ: প্রচলিত প্রথামতে, চাকমা পরিবারে কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার পুত্র বা পুত্রসন্তানরাই মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী। মৃত ব্যক্তির একাধিক পুত্রসন্তান থাকলে বা মৃত ব্যক্তির একাধিক স্ত্রীর গর্ভজাত পুত্রসন্তান থাকলে সকলে সমান অংশে পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়;
অপরদিকে পুত্রসন্তানের উপস্থিতিমাত্রই কন্যাসন্তানকে পিতার উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করে। সেক্ষেত্রে কন্যা শুধু পিতার সম্পত্তি থেকে বিয়ের পূর্ব পর্যন্ত এবং অবিবাহিতা/ চিরকুমারী কন্যা আজীবন ভরণপোষণের অধিকারী হয়।
অথচ দত্তক পুত্র, অবৈধপুত্র (যদি জন্মদাতা পিতা ছাড়া ভিন্ন কোনো ব্যক্তির পিতৃ পরিচয়ে পরিচিত না-হয়) পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকার দাবি করতে পারে। তবে ত্যাজ্য ঘোষিত পুত্রকে পিতার উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করার রীতিটি প্রতিষ্ঠিত কি না তা নিয়ে এখনো বিতর্ক রয়ে গেছে।
চাকমা প্রথাগত নিয়মে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হলো দত্তক পুত্রসন্তানের উপস্থিতিতে ঔরসজাত কন্যাসন্তানের পিতার উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া।
চাকমা পাহাড়ি নারীরা পৈতৃক সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে শুধু সম্পূর্ণ বঞ্চিতই নন, অপ্রতিরোধ্য উত্তরাধিকারী পুরুষের অবস্থানের ওপরও তা নির্ভরশীল।
আবার অন্যদিকে পিতা-মাতা জীবদ্দশায় ইচ্ছে করলে কন্যাকে দান/উইলমূলে সম্পত্তির অংশীদার করতে পারেন বা ভাইয়ের ইচ্ছে করলে বোনদের পৈতৃক সম্পত্তির ভাগ দিতে পারে। ভাইয়েরা অনাপত্তিপত্র দাখিলমূলে বোনদেরও পিতার উত্তরাধিকারী হিসেবে উত্তরাধিকার সনদপত্রে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে।
সুতরাং চাকমা নারীদের পৈতৃক সম্পত্তির মালিকানা বিষয়টি অনেকাংশে পুরুষের ইচ্ছাধীন। চাকমা আদিবাসী সমাজে এই বৈষম্যমূলক উত্তরাধিকারপ্রথা পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিরই চরম বহিঃপ্রকাশ।
তথ্যসূত্রঃ প্রথাগত আইনে আদিবাসী পাহাড়ী নারীর অবস্থান (সুস্মিতা চাকমা)।