পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস ও পরিচিতি বিশদ একটি প্রবন্ধ হওয়াতে এটিকে নিম্নলিখিত বেশ কয়েকটি অধ্যায়ে ভাগ করা যায়।
ভূমিকা ও প্রাকৃতিক-পারিপার্শ্বিক পরিচিতি
প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ইতিহাস
ঔপনিবেশিক শাসন ও ব্রিটিশ প্রশাসনের প্রভাব
পাকিস্তান আমলে পার্বত্য চট্টগ্রাম: কাপ্তাই বাঁধ ও বাস্তুচ্যুতি
স্বাধীন বাংলাদেশের শুরু এবং রাষ্ট্রীয় নীতি
শান্তিবাহিনী ও সশস্ত্র সংগ্রাম (১৯৭২–১৯৯৭)
পার্বত্য শান্তিচুক্তি (১৯৯৭): প্রেক্ষাপট, আলোচনা ও বাস্তবায়ন
সমসাময়িক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চিত্র
আদিবাসী সংস্কৃতি, ভাষা ও সমাজব্যবস্থা
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও নীতিগত সুপারিশ
পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস ও পরিচিতি –> ভূমিকা ও প্রাকৃতিক-পারিপার্শ্বিক পরিচিতি
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত একটি ভৌগোলিক, জাতিগত ও সাংস্কৃতিকভাবে বৈচিত্র্যপূর্ণ অঞ্চল হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম। বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে ভিন্নতর পরিবেশ, জাতিগোষ্ঠী, এবং জীবনধারার জন্য এই অঞ্চলটি ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলাদা গুরুত্ব বহন করে। দেশের মোট আয়তনের প্রায় এক দশমাংশ জায়গা নিয়ে গঠিত এই অঞ্চলটি কখনও উপেক্ষিত, আবার কখনও রাষ্ট্রীয় চ্যালেঞ্জের কেন্দ্রে থেকেছে।
এই অঞ্চলের পরিচিতি গড়ে উঠেছে বহু শতাব্দীর ইতিহাস, সংস্কৃতি, প্রতিরোধ ও সংগ্রামের মাধ্যমে। তাই “পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস” শুধু একটি অঞ্চলের বিবরণ নয়, বরং তা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ও সাংস্কৃতিক পরিকাঠামোর একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
ভৌগোলিক পরিচিতি
পার্বত্য চট্টগ্রাম তিনটি জেলা নিয়ে গঠিত:
রাঙ্গামাটি
খাগড়াছড়ি
বান্দরবান
এই অঞ্চলটি ভারতের ত্রিপুরা, মিজোরাম ও মায়ানমার সীমান্তে অবস্থিত। পার্বত্য এলাকা বললে যা বোঝায়, এ অঞ্চল তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ:
পাহাড়ি টিলার সারি
কর্ণফুলী, সাঙ্গু ও মাতামুহুরি নদী
কাপ্তাই হ্রদ (মানবসৃষ্ট বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ হ্রদ)
এই ভৌগোলিক বৈচিত্র্যই পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশের অন্যান্য সমতল এলাকার চেয়ে আলাদা করে তুলেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের মানচিত্র
জলবায়ু ও জীববৈচিত্র্য
পার্বত্য চট্টগ্রামের জলবায়ু মূলত গ্রীষ্মমন্ডলীয় আর্দ্র। বছরের বেশিরভাগ সময় এখানে বৃষ্টি হয়। এর ফলে অঞ্চলটি ঘন বনভূমি ও জীববৈচিত্র্যে ভরপুর।
উল্লেখযোগ্য প্রাণী:
হাতি
চিতাবাঘ
বানর
হরিণ
উল্লেখযোগ্য গাছপালা:
বাঁশ
রত্নগাছ
গর্জন
তেজপাতা
এছাড়া এখানকার বনের সাথে উপজাতি সমাজের জীবনযাপন সরাসরি জড়িত।
বসবাসরত জাতিগোষ্ঠী
পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করে প্রায় ১১টির বেশি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী, যাদের অনেকে নিজস্ব ভাষা, পোশাক, ধর্ম এবং রীতিনীতিতে স্বতন্ত্র।
প্রধান জনগোষ্ঠীসমূহ:
জাতিগোষ্ঠী
ধর্ম
প্রধান ভাষা
চাকমা
বৌদ্ধ
চাকমা
মারমা
বৌদ্ধ
মারমা
ত্রিপুরা
হিন্দু
কোকবোরক
তঞ্চঙ্গ্যা
বৌদ্ধ
তঞ্চঙ্গ্যা
ম্রো
বৌদ্ধ/Animist
ম্রো
বম
খ্রিস্টান
বম
খুমি
খ্রিস্টান
খুমি
এদের মধ্যে কিছু জাতি টিবেটো-বর্মা ভাষা পরিবারের অন্তর্গত।
অর্থনৈতিক ও কৃষিনির্ভর সমাজ
পার্বত্য চট্টগ্রামে মূলত জুম চাষ প্রচলিত। এটি পাহাড়ি এলাকায় একধরনের সনাতন কৃষি ব্যবস্থা, যেখানে একটি পাহাড়ি ঢালু জায়গা কেটে, আগুন দিয়ে জঙ্গল পরিষ্কার করে ফসল চাষ করা হয়।
অন্যান্য অর্থনৈতিক কার্যক্রম:
বাঁশ ও কাঠ কাটা
ফলমূল (আনারস, কলা, আম, জাম) উৎপাদন
হস্তশিল্প ও তাঁত বোনা
কাপ্তাই হ্রদে মাছ ধরা ও জলবিদ্যুৎ উৎপাদন
তবে উন্নয়নের বঞ্চনায় এই অঞ্চল এখনো দরিদ্র ও পিছিয়ে থাকা অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত।
ভৌগোলিক কৌশলগত গুরুত্ব
পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের জন্য শুধু প্রাকৃতিক সম্পদের উৎস নয়, এটি একটি কৌশলগত অবস্থানে অবস্থিত।
সীমান্ত ভাগ করে আছে ভারত ও মায়ানমারের সাথে।
সামরিক ও নিরাপত্তাগত দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ।
এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ ও বাণিজ্যের জন্য একটি প্রবেশদ্বার হিসেবেও ব্যবহৃত হতে পারে।
এ কারণে বাংলাদেশ সরকার বারবার এখানে উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্যোগ নিয়েছে, যার অনেকগুলো আবার আদিবাসী স্বার্থের সাথে সাংঘর্ষিক হয়েছে।
এ সমস্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বাংলাদেশকে আরও বৈচিত্র্যময় করে তোলে।
সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক দৃষ্টিকোণ
পার্বত্য চট্টগ্রাম আগে ছিল “Excluded Area” — যা ব্রিটিশরা প্রশাসনিকভাবে স্বতন্ত্র করে রেখেছিল। পরবর্তীতে এটি পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ উভয় সময়েই বিশেষ প্রশাসনিক মর্যাদা পেয়েছে।
বর্তমানে রয়েছে:
জেলা পরিষদ
আঞ্চলিক পরিষদ
ত্রিস্তর বিশিষ্ট চাকমা- মারমা- ত্রিপুরা সার্কেল চিফ ব্যবস্থাপনা
পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস ও পরিচিতি –> প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস
পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস শুধু বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অংশ নয়; এটি একটি স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও জাতিগত ধারাবাহিকতার চিত্র। বহু প্রাচীনকাল থেকেই এ অঞ্চলটি ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যেখানে বসবাস করত বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী—তাদের নিজস্ব শাসনব্যবস্থা, সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক কাঠামো নিয়ে।
প্রাচীন যুগে পার্বত্য চট্টগ্রাম
️ আর্য-অনার্য বিন্যাস ও জাতিগত উৎস
প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশে আর্যদের আগমনের পূর্বে এই অঞ্চলে মূলত অনার্য উপজাতিদের বসবাস ছিল।
ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা যায়, পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের অধিকাংশ টিবেটো-বর্মান ভাষাপরিবারভুক্ত।
এই অঞ্চলে পূর্ব থেকেই ছিল মঙ্গোলীয় নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর বসতি, যারা ভিন্ন ভিন্ন উপত্যকায় ছড়িয়ে বসবাস করতেন।
ইতিহাসের প্রথম দৃষ্টিগোচর
পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য ও পুরাণেও উল্লেখিত হয় না, যার ফলে এটি ঐতিহাসিকভাবে ‘বহির্ভূত অঞ্চল’ হিসেবে বিবেচিত হতো।
তবে কিছু পাল ও সেন আমলের শিলালিপি এবং ত্রিপুরা রাজ্যের অভিলেখ হতে ধারণা পাওয়া যায় যে, এই অঞ্চলটি উত্তর-পূর্ব ভারতের ছোট ছোট রাজ্য ও প্রধানদের প্রভাবাধীন ছিল।
পর্তুগীজের আঁকা মানচিত্রে চাকোমাস রাজ্য
খ্রিস্টীয় প্রথম সহস্রাব্দে রাজনৈতিক কাঠামো
খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শতাব্দীর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম একটি নিরপেক্ষ ও সীমান্তবর্তী অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত হতো।
এটি ত্রিপুরা, আরাকান ও কামরূপ রাজ্যের মধ্যবর্তী সীমান্তে অবস্থিত থাকায় এ অঞ্চল ছিল একটি buffer zone।
এই সময়ের মধ্যে আদিবাসীদের সমাজব্যবস্থায় ছিল উপ-প্রধান, বংশীয় নেতা এবং আঞ্চলিক শাসনব্যবস্থা।
আরাকান রাজ্যের শাসন (১০ম – ১৫শ শতক)
পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সংযুক্তি ঘটে আরাকান রাজ্যের সাথে।
আরাকান রাজ্যের প্রভাব:
আরাকান ছিল বর্তমানে মায়ানমারের রাখাইন অঞ্চলের রাজ্য।
১০ম শতাব্দী থেকে রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান অঞ্চল আরাকান শাসনের আওতায় ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।
মারমা জনগোষ্ঠী, যারা আজ পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি বড় জাতি, তারা আরাকান থেকে এ অঞ্চলে আগত।
⛩️ সাংস্কৃতিক ছাপ:
বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার ঘটে এ সময়।
মারমাদের স্থায়ী বসতি শুরু হয়।
স্থাপত্য, ভাষা ও উৎসব আরাকানি সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয়।
ত্রিপুরা রাজ্যের শাসন
পূর্ব ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যও পার্বত্য চট্টগ্রামের একাংশে প্রভাব বিস্তার করেছিল।
ত্রিপুরা রাজবংশের শিলালিপি ও রাজবংশীয় বংশাবলি থেকে জানা যায় যে, খাগড়াছড়ি অঞ্চলের কিছু অংশ ছিল তাদের করদ রাজ্য।
ত্রিপুরা থেকে ত্রিপুরা, রিয়াং, ও চাক গোষ্ঠীগুলি পার্বত্য চট্টগ্রামে আগমন করে এবং বসতি গড়ে তোলে।
স্থানীয় আদিবাসী শাসনব্যবস্থা
এই সময়টাতে প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব উপপ্রধান বা হেডম্যান ছিল, যারা স্বশাসনে পরিচালিত হতেন।
প্রশাসনিক কাঠামো:
স্তর
ভূমিকা
রাজা বা চিফ
ঐতিহ্যগত জাতিগোষ্ঠীর সর্বোচ্চ নেতা
কার্বারী
গ্রাম প্রধান
হেডম্যান
বড় এলাকার নেতা, কর সংগ্রহকারী
সাধারণ জনগণ
কৃষি ও জীবনধারায় নিয়োজিত
এ ব্যবস্থার মাধ্যমে এক ধরনের সামাজিক স্থিতিশীলতা ও আত্মপরিচয় বজায় ছিল।
ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতি
প্রাচীন যুগে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ মূলত ছিল:
Animist (প্রকৃতি পূজারী)
পরে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব বিস্তার করে মারমা, চাকমা, তঞ্চঙ্গ্যা প্রভৃতির মধ্যে।
ধর্মীয় রীতি:
বন ও নদী পূজা
পিতৃতান্ত্রিক ও মাতৃতান্ত্রিক উভয়ধরনের সামাজিক কাঠামো
ইতিহাসের প্রামাণ্য সংকট
প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস রচনায় যে সমস্যা প্রধান:
লিখিত রেকর্ডের অভাব
ব্রিটিশ আমলের পূর্বে স্থানীয় সমাজে লিখনপদ্ধতি না থাকায় ইতিহাস ছিল মুখে মুখে প্রচলিত।
অধিকাংশ তথ্য পাওয়া যায় প্রতিবেশী রাজ্যগুলোর শিলালিপি ও রাজবংশের নথিপত্রে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস ও পরিচিতি -> ঔপনিবেশিক শাসন ও ব্রিটিশ প্রশাসনের প্রভাব
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের মাধ্যমে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজনৈতিক আধিপত্য শুরু হয়। ১৮৬০ সালে ব্রিটিশরা পার্বত্য চট্টগ্রামকে তাদের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে আনে। এই অধ্যায়ে আমরা দেখব—
কীভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্রিটিশ উপনিবেশের অংশ হয়ে উঠেছিল, কী ছিল শাসনব্যবস্থা, কীভাবে ভূমি ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটানো হয়েছিল এবং এসবের প্রভাব কী পড়েছিল এখানকার আদিবাসী সমাজ, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতে।
১. ব্রিটিশ আগমনের প্রেক্ষাপট
১৭৬০ সালের দিকে ব্রিটিশরা বাংলার দেওয়ানি লাভ করে।
এর ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের নিম্নাঞ্চল ধীরে ধীরে ব্রিটিশ শাসনের আওতাভুক্ত হতে থাকে।
১৮৬০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি আলাদা জেলা ঘোষণা করা হয়।
️ প্রশাসনিক বিভাজন:
পার্বত্য চট্টগ্রামকে তিনটি সার্কেলে বিভক্ত করা হয়:
চাকমা সার্কেল
মারমা বা বোমং সার্কেল
তঞ্চঙ্গ্যা বা মং সার্কেল
২. ব্রিটিশ ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা
ব্রিটিশরা এখানে তাদের নিজস্ব ভূমি কর ব্যবস্থা (Land Revenue System) প্রবর্তন করে।
বিষয়
বিবরণ
কর সংগ্রহ
আদিবাসী ‘হেডম্যান’ এবং ‘কার্বারীদের’ মাধ্যমে সংগৃহীত
ভূমির মালিকানা
ব্যক্তি মালিকানার পরিবর্তে সম্প্রদায়িক মালিকানা বজায় রাখে
বনভূমি আইন
১৮৭৮ সালে Forest Act চালু করে, যার ফলে বহু আদিবাসী বনভূমি থেকে উৎখাত হয়
➡️ এতে ভূমির উপর আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত অধিকার খর্ব হয়।
৩. পার্বত্য চট্টগ্রাম ম্যানুয়াল, ১৯০০
১৮৮১ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ব্রিটিশ শাসন থেকে বিশেষভাবে পৃথক করা হয় এবং ১৯০০ সালে Chittagong Hill Tracts Regulation 1900 প্রণয়ন করা হয়।
️ মূল বৈশিষ্ট্য:
বহিরাগতদের প্রবেশ নিষেধ: ব্রিটিশ ছাড়া অন্যান্য বাঙালিরা এ অঞ্চলে প্রবেশ করতে পারত না।
ভূমি বিক্রি নিষেধ: আদিবাসীদের বাইরে অন্য কেউ জমি কিনতে পারত না।
আদিবাসী প্রশাসনকে স্বীকৃতি: সার্কেল চিফদের সরকারিভাবে স্বীকৃতি ও বেতন দেওয়া শুরু হয়।
➡️ এটি ছিল ভারতের উপনিবেশিক শাসনে একটি বিচ্ছিন্ন অঞ্চল (Excluded Area)।
৪. খ্রিস্টান মিশনারি ও শিক্ষা প্রসার
ব্রিটিশ আমলে খ্রিস্টান মিশনারিরা পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করে।
ভূমিকা:
স্কুল ও স্বাস্থ্যসেবা চালু করে, যার ফলে শিক্ষার হার কিছুটা বাড়ে।
চাকমা ও মারমা জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান সম্প্রদায় গঠিত হয়।
তবে অনেক আদিবাসী এতে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ভয় অনুভব করে।
৫. আদিবাসী সমাজে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব
ক্ষেত্র
প্রভাব
প্রশাসন
চিফদের ক্ষমতা সংরক্ষিত থাকলেও তা ছিল ব্রিটিশদের অনুমোদিত
সংস্কৃতি
খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার ও ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটে
অর্থনীতি
কেশিয়া ও বাঁশ ব্যবসা বাড়ে, তবে বাঙালি ব্যবসায়ীদের আগমন ঘটায় অর্থনৈতিক শোষণ শুরু হয়
অভিবাসন
চট্টগ্রামের সমতল অঞ্চল থেকে বাঙালি অভিবাসন বেড়ে যায়, যা স্থানীয়দের জমি সংকটে ফেলে
পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস ও পরিচিতি -> পাকিস্তান আমলে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও আত্মপরিচয়ের সংকট
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান ও ভারত দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হয়। পূর্ব বাংলা হয়ে উঠে পাকিস্তানের পূর্বাংশ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম অন্তর্ভুক্ত হয় পূর্ব পাকিস্তানে। কিন্তু স্বাধীনতার এই প্রক্রিয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের কোনো মতামত নেওয়া হয়নি।
এই অধ্যায়ে আমরা জানব কীভাবে পাকিস্তান আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে এবং কীভাবে তা আদিবাসীদের আত্মপরিচয়ের সংকটে ঠেলে দেয়।
১. ভারত ভাগ ও পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্তর্ভুক্তি
১৯৪৭ সালের বিভাজন প্রেক্ষাপট:
পার্বত্য চট্টগ্রামের ৯৮% জনগণ ছিল বৌদ্ধ বা অন্যান্য আদিবাসী ধর্মাবলম্বী।
বহু রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে, এই অঞ্চল ভারতের অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত ছিল। এমনকি র্যাডক্লিফ লাইনেও শুরুতে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভারতের অংশ হিসেবে দেখানো হয়েছিল।
কিন্তু শেষ মুহূর্তে রাজনৈতিক চাপে অঞ্চলটি পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
➡️ এই ঘটনাকে অনেকে ঐতিহাসিক বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে চিহ্নিত করেন।
২. প্রশাসনিক বৈষম্য ও মুসলিমীকরণ নীতি
ক্ষেত্র
পাকিস্তান সরকারের পদক্ষেপ
ধর্ম
মুসলিম সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়া হয়
শিক্ষা
বাংলা ও উর্দু মাধ্যমে শিক্ষা চালু হয়, আদিবাসী ভাষা উপেক্ষিত
ভূমি
বহিরাগত মুসলিম অভিবাসীদের পার্বত্য চট্টগ্রামে পুনর্বাসন করা হয়
রাজনৈতিক অধিকার
সার্কেল প্রধানদের ক্ষমতা কমিয়ে দেওয়া হয়
➡️ এতে আদিবাসীদের মধ্যে গভীর আত্মপরিচয়ের সংকট তৈরি হয়।
৩. কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ ও গণউচ্ছেদ
️ কাপ্তাই বাঁধ (Karani Project):
নির্মাণকাল: ১৯৫৭–১৯৬২
আয়োজক: পাকিস্তান সরকার ও মার্কিন সাহায্য সংস্থা (USAID)
উদ্দেশ্য: জলবিদ্যুৎ উৎপাদন
প্রভাব:
দিক
ফলাফল
গ্রাম সংখ্যা
প্রায় ১৮,০০০ পরিবার উচ্ছেদ
বাস্তুচ্যুত
প্রায় ১ লক্ষ আদিবাসী
ভারত ও মিয়ানমারে পলায়ন
হাজার হাজার চাকমা শরণার্থী হয়ে পড়েন
➡️ এটি ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আদিবাসী উচ্ছেদের ঘটনা।
৪. সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও পরিচিতি বিলোপের প্রচেষ্টা
চাকমা ও মারমা নাম পরিবর্তন করে “বাঙালি” হিসেবে পরিচিত করানোর চেষ্টায় ছিল পাকিস্তান সরকার।
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও বৌদ্ধ বিহারকে অগ্রাধিকার না দিয়ে মাদ্রাসা ও মসজিদ নির্মাণে জোর দেওয়া হয়।
আদিবাসী পোশাক ও উৎসব নিষিদ্ধ করার প্রস্তাবও ওঠে।
➡️ এগুলো আদিবাসীদের মধ্যে সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ ও সচেতনতার জন্ম দেয়।
৫. রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও সংগঠন
১৯৬০-এর দশকে আদিবাসী যুবকদের মধ্যে প্রতিবাদ ও সংগঠনের সূচনা হয়।
গঠিত হয় কিছু স্থানীয় সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠন, যেগুলো পরবর্তীতে আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি তোলে।
➡️ এই সময়কালেই আদিবাসীদের মধ্যে “জাতিসত্ত্বা” ও “স্বায়ত্তশাসন” চেতনার উন্মেষ ঘটে।
৬. ভূমি ও অভিবাসন ইস্যু
পাকিস্তান সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে:
নতুন মুসলিম বসতি স্থাপন করে।
আদিবাসীদের নাম রেকর্ড না করে ভূমির মালিকানা কৌশলে দখল করে নেয়।
মুসলিমদের জন্য বাসস্থান, শিক্ষা, চাকরি ও আর্থিক সুবিধা চালু করে, কিন্তু আদিবাসীদের বঞ্চিত রাখে।
➡️ এই নীতিকে আদিবাসীরা “সংস্কৃতিগত উপনিবেশবাদ” (Cultural Colonization) বলে উল্লেখ করেন।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস ও পরিচিতি -> স্বাধীন বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রামের সংগ্রাম ও চুক্তির আগের পরিস্থিতি
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্মের পর নতুন আশার সঞ্চার হয়েছিল দেশের সব জনগণের মধ্যে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরাও আশা করেছিলেন, এবার তারা সাংবিধানিক অধিকার, সাংস্কৃতিক স্বীকৃতি এবং ভূমির নিরাপত্তা লাভ করবেন। কিন্তু নতুন রাষ্ট্রের নীতিতে তাদের জাতিগত স্বীকৃতি না থাকায় হতাশা এবং আন্দোলনের পথেই হাঁটতে হয়। এই অধ্যায়ে আমরা বিশ্লেষণ করব কীভাবে স্বাধীন বাংলাদেশেও পার্বত্য চট্টগ্রামে জাতিগত বঞ্চনা, সামরিকীকরণ এবং দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত তৈরি হয়।
১. ১৯৭১-এর স্বাধীনতা ও আদিবাসীদের প্রত্যাশা
স্বাধীনতার পরপরই:
আদিবাসী নেতারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মারকলিপি দেন (১৯৭২)।
দাবিগুলোর মধ্যে ছিল:
আদিবাসী জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি
আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন
সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত অধিকার রক্ষা
➡️ কিন্তু বঙ্গবন্ধু এই দাবিগুলো প্রত্যাখ্যান করেন এবং বলেন:
“বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী নেই, সবাই বাঙালি।”
এ বক্তব্যে আদিবাসীদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ তৈরি হয়।
২. জুম্ম জাতিসত্তা ও শন্তি বাহিনীর উত্থান
✊ জুম্ম জাতিসত্তা ধারণার সূচনা:
জুম্ম বলতে বোঝায়: যারা ‘জুম চাষ’ করে—চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, বম, খিয়াং, মুরং, লুসাই, পাংখো ও অন্যান্য পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠী।
এই জাতিগোষ্ঠীগুলো “জুম্ম জাতি” হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেয়।
“শান্তি বাহিনী” গঠন:
১৯৭২ সালে গঠন হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (PCJSS)—মনোরঞ্জন ধর ও জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু লারমা)-এর নেতৃত্বে।
১৯৭৭ সালে PCJSS-এর সশস্ত্র শাখা শান্তি বাহিনী গঠিত হয়।
➡️ লক্ষ্য ছিল: আদিবাসীদের অধিকার আদায়ের জন্য সশস্ত্র প্রতিরোধ।
৩. বাঙালি পুনর্বাসন ও জাতিগত দ্বন্দ্ব
১৯৭৯ সাল থেকে বিভিন্ন সময়:
পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি বসতি স্থাপনে সরকার পৃষ্ঠপোষকতা করে।
প্রায় ৪ লক্ষ বাঙালি পরিবার পার্বত্য এলাকায় পুনর্বাসিত হয়।
ফলাফল:
ভূমি দখল
আদিবাসীদের বাস্তুচ্যুতি
সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংঘর্ষ
➡️ এই পুনর্বাসন নীতিকে জুম্ম জনগণ “সংস্কৃতি নির্মূলের চক্রান্ত” হিসেবে দেখে।
৪. সামরিকীকরণ ও মানবাধিকার লঙ্ঘন
বিষয়
বিবরণ
সামরিক ঘাঁটি
পার্বত্য চট্টগ্রামে শতাধিক সেনা ক্যাম্প স্থাপন
সেনা অভিযান
শান্তি বাহিনী দমনে বহু অভিযান
মানবাধিকার
ধর্ষণ, হত্যা, গুম, গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া ইত্যাদি ঘটনার অভিযোগ
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও মিডিয়া বিষয়টি বিভিন্ন সময়ে তুলে ধরে।
৫. পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (PCJSS) ভূমিকা
PCJSS:
পাহাড়িদের সাংগঠনিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করে।
স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আদিবাসীদের অধিকার নিয়ে আলোচনা চালায়।
শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নেয়।
➡️ কিন্তু নিরস্ত্রীকরণের আগে কোনো দাবিই পূরণ হয়নি।
৬. সংলাপ ও চুক্তির চেষ্টা
১৯৮৫–১৯৯৬ পর্যন্ত সময়ে একাধিকবার সরকার ও PCJSS-এর মধ্যে আলোচনার উদ্যোগ হয়।
শান্তি চুক্তির রূপরেখা নির্ধারণে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার চাপও ছিল।
শেষমেশ ১৯৯৭ সালে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পথ তৈরি হয়, যা আমরা পরবর্তী অধ্যায়ে বিশ্লেষণ করব।
৭. এই সময়ের সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ
এই সময়ে আদিবাসী যুবসমাজ:
নাটক, গান, কবিতা ও সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ গড়ে তোলে।
“জুম্ম সংস্কৃতি” এবং ভাষা রক্ষায় সংগঠন তৈরি করে।
➡️ পাহাড়ে গড়ে ওঠে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের একটি নতুন তরঙ্গ।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস ও পরিচিতি -> পার্বত্য শান্তিচুক্তি ১৯৯৭ — স্বাক্ষর, বাস্তবায়ন ও বিতর্ক
দীর্ঘ দুই দশকের সশস্ত্র সংঘাত, দমননীতি এবং বঞ্চনার পর অবশেষে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (PCJSS) মধ্যে “পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি” স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিকে অনেকে স্বাগত জানালেও বিভিন্ন মহল থেকে এসেছে প্রশ্ন ও সমালোচনা। এ অধ্যায়ে চুক্তির প্রেক্ষাপট, প্রধান ধারা, বাস্তবায়নের অগ্রগতি ও প্রতিবন্ধকতা বিশ্লেষণ করা হবে।
১. চুক্তির পটভূমি
চুক্তির প্রয়োজনীয়তা কেন উঠল:
দীর্ঘদিন ধরে চলা সশস্ত্র সংঘাতে হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়।
স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ বাড়তে থাকে।
রাজনৈতিকভাবে দেশকে স্থিতিশীল করতে সরকারের প্রয়োজন পড়ে একটি টেকসই সমাধান।
➡️ ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর, নতুন করে শান্তি আলোচনার উদ্যোগ নেয়।
২. শান্তিচুক্তির স্বাক্ষর
তারিখ: ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭ পক্ষসমূহ:
বাংলাদেশ সরকার
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (PCJSS)
চুক্তি স্বাক্ষর করেন:
সরকারের পক্ষে: আবুল হাসান চৌধুরী (তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী)
পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস ও পরিচিতি -> পার্বত্য চট্টগ্রামের সমসাময়িক সংকট ও সম্ভাবনা
পার্বত্য চট্টগ্রাম (Chittagong Hill Tracts – CHT) আজ আর শুধু ইতিহাসের এক গৌরবময় অধ্যায় নয়; বরং এটি বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অঞ্চল, যা বর্তমানে নানা সংকটের পাশাপাশি বিশাল সম্ভাবনাও ধারণ করছে। এই অধ্যায়ে আলোচনা করা হবে আধুনিক সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান সংকট, সেইসঙ্গে সেখানে যে সম্ভাবনাগুলো রয়েছে, সেগুলোর বিশ্লেষণ।
১. সমসাময়িক প্রধান সংকটসমূহ
ক. ভূমি বিরোধ ও দখল
ভূমি কমিশনের কার্যকারিতা অত্যন্ত দুর্বল।
আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জমি অবৈধভাবে দখল করে বসতি স্থাপন হচ্ছে।
ভূমি আইন না থাকায় আদিবাসীদের আইনি নিরাপত্তা নেই।
ভূমি বিরোধই এখন পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে জটিল ও সহিংসতার মূল কারণ।
খ. সাংবিধানিক স্বীকৃতির অভাব
আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে “আদিবাসী” হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।
সরকার “ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী” শব্দ ব্যবহার করলেও তা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে গ্রহণযোগ্য নয়।
এর ফলে জাতিসংঘের আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্র অনুসারে সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
গ. শিক্ষার সংকট
মাতৃভাষাভিত্তিক শিক্ষা কার্যকরভাবে চালু হয়নি।
পাহাড়ি এলাকার স্কুলগুলোতে শিক্ষক সংকট চরম।
শিক্ষাব্যবস্থায় পাহাড়ি সংস্কৃতি ও ইতিহাস উপেক্ষিত।
ঘ. উন্নয়ন প্রকল্পে স্থানীয় অংশগ্রহণ কম
CHT-এ উন্নয়ন কাজ চলছে, কিন্তু অধিকাংশ প্রকল্পে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ নেই।
প্রকল্পগুলো ঢাকা-কেন্দ্রিক এবং নগরভিত্তিক উন্নয়নের প্রতিচ্ছবি বহন করে।
ঙ. সামরিক উপস্থিতি
শান্তিচুক্তির ২৫ বছর পরও সেনা ক্যাম্প এখনো রয়েছে।
অনেক পাহাড়ি নাগরিক মনে করেন এটি তাদের ভয়ভীতি ও নিয়ন্ত্রণের প্রতীক।
২. সম্ভাবনার বিশ্লেষণ
✅ পর্যটন
বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি — প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ভান্ডার।
“ইকো-ট্যুরিজম” এবং “কালচারাল ট্যুরিজম” এর অপার সম্ভাবনা রয়েছে।
✅ কৃষি ও অর্গানিক পণ্য
পাহাড়ি অঞ্চলের ঝুম চাষ এবং জৈব ফসল উৎপাদন সম্ভাবনাময়।
হাইভ্যালু ক্রপস যেমন কফি, কাজু, আদা, কমলা ইত্যাদির রপ্তানির সুযোগ।
✅ ক্রস-কালচারাল শিক্ষা ও গবেষণা
এখানে ১১টির বেশি নৃ-গোষ্ঠী বসবাস করে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম সংস্কৃতি, ভাষা, সমাজ বিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞান গবেষণার জন্য আদর্শ অঞ্চল।
✅ আদিবাসী নারী নেতৃত্ব
পাহাড়ি নারীরা দিনদিন শিক্ষা ও অধিকার সচেতনতা অর্জন করছেন।
তারা এখন রাজনীতি, সমাজসেবা ও ব্যবসা উদ্যোগে অংশ নিচ্ছেন।
৩. ভবিষ্যতের করণীয়
করণীয়
বিবরণ
✅ সাংবিধানিক স্বীকৃতি
আদিবাসীদের যথাযথ স্বীকৃতি দিতে হবে
✅ ভূমি আইন প্রণয়ন
ভূমি কমিশনকে শক্তিশালী ও কার্যকর করা
✅ মাতৃভাষাভিত্তিক শিক্ষা
শিক্ষা নীতিতে নৃগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি অন্তর্ভুক্তি
পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস ও পরিচিতি -> পার্বত্য চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও পরিচিতি
পার্বত্য চট্টগ্রাম (Chittagong Hill Tracts) শুধু একটি ভৌগোলিক অঞ্চল নয়, বরং এটি বাংলাদেশের অন্যতম বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক এলাকা। এখানে বসবাসকারী বিভিন্ন নৃগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব ভাষা, ধর্ম, পোশাক, উৎসব এবং জীবনধারার মাধ্যমে এক অনন্য সাংস্কৃতিক পরিচয় গড়ে তুলেছে। এই অধ্যায়ে আমরা আলোচনা করব পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান জাতিগোষ্ঠীগুলোর সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও তা থেকে উদ্ভূত জাতীয় গুরুত্ব সম্পর্কে।
১. পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান নৃগোষ্ঠীসমূহ
পার্বত্য চট্টগ্রামে ১১টিরও বেশি নৃগোষ্ঠী বসবাস করে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
নৃগোষ্ঠীর নাম
প্রধান বসবাস এলাকা
ধর্ম
চাকমা
রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি
বৌদ্ধ
মারমা
বান্দরবান, রাঙামাটি
বৌদ্ধ
ত্রিপুরা
খাগড়াছড়ি
হিন্দু
তঞ্চঙ্গ্যা
রাঙামাটি
বৌদ্ধ
মুরং
বান্দরবান
বৌদ্ধ/Animist
খিয়াং
বান্দরবান
বৌদ্ধ
লুসাই
সীমান্তবর্তী বান্দরবান
খ্রিস্টান/Animist
পাংখোয়া
সীমান্তবর্তী অঞ্চল
খ্রিস্টান
২. ভাষাগত বৈচিত্র্য
প্রায় প্রতিটি নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা ও উপভাষা রয়েছে।
চাকমা ভাষা ভারতীয় লিপিতে লিখিত এবং একে স্বতন্ত্র সাহিত্য রয়েছে।
মারমা ভাষা অনেকটাই বার্মিজ ভাষার কাছাকাছি।
অনেক ভাষা আজ বিলুপ্তপ্রায়, নতুন প্রজন্ম বাংলা ও ইংরেজির দিকে ঝুঁকছে।
৩. পোশাক ও অলংকার
নারীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক যেমন থামি, রিনাই, সিলু ইত্যাদি।
পুরুষদের জন্য রয়েছে ধুতি, পাঞ্জাবি, গামছা ইত্যাদি।
হাতে তৈরি আলপনা, পুঁতির গয়না, ধাতব অলংকার বিশেষভাবে জনপ্রিয়।
এইসব অলংকার ও পোশাক আজ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ফ্যাশনে স্থান করে নিচ্ছে।
৪. উৎসব ও আচার
বৌদ্ধ ধর্মীয় উৎসব:
বৈসাবি (বিজু-সাংগ্রাইং-বৈসু): পাহাড়িদের নববর্ষ উৎসব, যা এপ্রিল মাসে উদযাপন করা হয়।
বুদ্ধপূর্ণিমা: বুদ্ধের জন্ম, বোধিপ্রাপ্তি ও মহাপরিনির্বাণ দিবস একসাথে পালন।
আদিবাসী উৎসব ও ঐতিহ্য:
মেলা ও নাচ-গান: বাঁশি, ঢোল, গোম্বা, নাগরা ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহৃত হয়।
আনুষ্ঠানিক বিয়ে ও মৃত্যু উৎসব: প্রতিটি জাতির আলাদা আচার-অনুষ্ঠান রয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস ও পরিচিতি -> পার্বত্য শান্তিচুক্তি – ইতিহাস, বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য শান্তি সহজে আসেনি। দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্র এবং পার্বত্য আদিবাসীদের মধ্যে সংঘাত চলতে থাকে। সেই প্রেক্ষাপটে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত হয় “পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি”, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত। এই অধ্যায়ে আমরা শান্তিচুক্তির প্রেক্ষাপট, মূল বিষয়বস্তু, বাস্তবায়ন পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ নিয়ে বিশ্লেষণ করব।
১. শান্তিচুক্তির প্রেক্ষাপট
স্বাধীনতার পর পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমি অধিকার, স্বায়ত্তশাসন, সাংস্কৃতিক স্বীকৃতি ইত্যাদি দাবি উঠতে থাকে।
১৯৭২ সালে পার্বত্য জনসংহতি সমিতি (PCJSS) গঠিত হয়, যার নেতৃত্বে ছিলেন সন্তু লারমা।
১৯৮০-এর দশকে সশস্ত্র গেরিলা যুদ্ধ শুরু হয় PCJSS ও সরকার বাহিনীর মধ্যে।
দীর্ঘ আলোচনার পর ১৯৯৭ সালে শেখ হাসিনা সরকারের সময় শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
২. শান্তিচুক্তির মূল দিকনির্দেশনা
২.১ প্রশাসনিক কাঠামো:
পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের ক্ষমতা বৃদ্ধি।
প্রতিটি জেলার জন্য নির্বাচিত স্থানীয় পরিষদ।
২.২ ভূমি সংক্রান্ত বিষয়:
একটি ভূমি কমিশন গঠনের কথা বলা হয়।
ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য নিরপেক্ষ ও পার্বত্য বান্ধব নীতির ঘোষণা।
২.৩ নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়:
সেনা ক্যাম্প পর্যায়ক্রমে প্রত্যাহার করার নির্দেশনা।
সাধারণ নিরাপত্তা রক্ষায় স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যকর উপস্থিতি নিশ্চিত করার কথা বলা হয়।
২.৪ শরণার্থী ও পুনর্বাসন:
ভারতীয় সীমান্ত থেকে ফিরে আসা পার্বত্য শরণার্থীদের পুনর্বাসন।
চিহ্নিত ১২,০০০+ পরিবারকে জমি, ঘর, খাদ্য ও পুনর্বাসন সহায়তা।
২.৫ সাংস্কৃতিক স্বীকৃতি:
আদিবাসীদের ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনধারার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও রক্ষা।
৩. চুক্তি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া
বিষয়
অগ্রগতি
সমস্যাবলী
জেলা ও আঞ্চলিক পরিষদ
গঠিত হয়েছে
রাজনৈতিক প্রভাব, কার্যকর ক্ষমতা হস্তান্তর হয়নি
ভূমি কমিশন
গঠিত
কার্যকর ভূমিকা নেই, সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বিলম্ব
সেনা প্রত্যাহার
আংশিক হয়েছে
কিছু ক্যাম্প এখনো রয়ে গেছে
পুনর্বাসন
আংশিক বাস্তবায়ন
কিছু পরিবার এখনো সহায়তা পায়নি
৪. চুক্তি বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ
রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব: সরকারের মধ্যে ধারাবাহিকতা ও মনোযোগের ঘাটতি।
ভূমি বিরোধ: কমিশনের কার্যকারিতা না থাকায় সমাধান ব্যাহত।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাস ও পরিচিতি -> পার্বত্য চট্টগ্রামের সম্ভাবনা ও উন্নয়নের ভবিষ্যৎ পথ
পার্বত্য চট্টগ্রাম (CHT) শুধু একটি ভৌগোলিক এলাকা নয়—এটি বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, আদিবাসী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং সম্ভাবনার এক বিশাল ভাণ্ডার। এই অঞ্চলের উন্নয়ন শুধুমাত্র পাহাড়িদের কল্যাণ নয়, বরং বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নের সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই অধ্যায়ে আমরা আলোচনা করব পার্বত্য চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং টেকসই উন্নয়নের সম্ভাবনা ও সেই সম্ভাবনা বাস্তবায়নের করণীয়।
পার্বত্য চট্টগ্রাম একাধারে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও উন্নয়নের সম্ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু। সঠিক পরিকল্পনা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতিমালার মাধ্যমে এই অঞ্চলকে একটি স্মার্ট, টেকসই ও শান্তিপূর্ণ মডেল অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব।
জুমজার্নালে প্রকাশিত লেখাসমূহে তথ্যমূলক ভুল-ভ্রান্তি থেকে যেতে পারে অথবা যেকোন লেখার সাথে আপনার ভিন্নমত থাকতে পারে। আপনার মতামত এবং সঠিক তথ্য দিয়ে আপনিও লিখুন অথবা লেখা পাঠান। লেখা পাঠাতে কিংবা যেকোন ধরনের প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন - jumjournal@gmail.com এই ঠিকানায়।